শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

হৃদয়ে বোহেমিয়ান এক সোয়ালো

প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ৬:০৮ অপরাহ্ণ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ৬:০৮ অপরাহ্ণ
হৃদয়ে বোহেমিয়ান এক সোয়ালো

পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম অভিবাসীবান্ধব নগরী লস এঞ্জেলেসে একটানা একযুগ বসবাস করে এবার অভিবাসীত হলাম যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের শহর আটলান্টায়। বস্তুত সেই ২০০৮ সালের এই সেপ্টেম্বরে যখন প্রিয় স্বদেশ ছাড়ি তখন থেকেই আমি অভিবাসী। সারা পৃথিবীরই অভিবাসী আমি। লস এঞ্জেলেস ছিল আমার বসবাসের দ্বিতীয় নগরী। জন্মস্থান খুলনার পরেই এখানে ছিল আমার জীবনের দ্বিতীয় দীর্ঘতম সময় যাপন। এবছর মার্চের শুরুতে আমি ছেড়ে যাই লস এঞ্জেলেস তারপর থেকেই নিজের কাছেই নিজেকে বেশ যাযাবর যাযাবর মনে হতে লাগল।

তিনযুগের জীবন ছেড়ে আমি যখন দেশ ছেড়ে আসি ২০০৮ সালের শরতে দেশের আকাশে তখন পেজা পেজা তুলার মত সাদা সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। মাঠে-ঘাটে সাদা কাশফুল ফুটে দিগন্ত ভাসিয়ে দিয়েছে শুভ্রতায় । ভেজা বাতাসে ধূপ আর ধুনোর গন্ধের সাথে ঢাক ও ঢোলের বাদ্যের আওয়াজ ভেসে আসতে শুরু করেছে। শারদীয় উৎসবের আমেজ চারিদিকে।

আর কোনও দিন ফিরে আসব না জেনেই আমি আমার জন্ম মাসেই দেশ ছেড়েছিলাম চিরদিনের জন্য। তার আগে শৈশব থেকে কৈশোর যৌবন পেরিয়ে একই নগরে কাটিয়েছিলাম তিন তিনটে যুগের জীবন। যে নগরের প্রতিটি ধূলিকণা আমাকে চিনত, প্রতিটি অলিগলির অন্ধকার আমাকে চিনত, প্রতিটি প্রাসাদ আর দেয়াল আমাকে চিনত। একদিন ছেড়ে যেতে হবে এই মনোটোনাস নগরীর সোডিয়াম লাইট, শঙ্খ মার্কেট, হাদিস পার্ক, পিকচারপ্যালেস, ডাকবাংলোর মোড় মোটেও ভাবিনি তা। এমন কি ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছেও তেমন ছিল না। তবুও কখন যেন কিভাবে উড়াল দিলাম বালিহাঁস হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের পাড়ে।

সান ফ্রান্সিস্কোতে বছরখানেক ট্রানজিট কাটিয়ে লস এঞ্জেলেসে যখন আসলাম তখন মনে হলো মায়ের কাছে না হলেও মাসির কাছে হয়তো আসতে পেরেছি। সুবৃহৎ বাংলাদেশি কমিউনিটি। জমজমাট প্রাণোচ্ছল আড্ডা। থার্ড স্ট্রিট, লিটল বাংলাদেশ। সারাবছর কত কত সামাজিক সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। মিশে গেলাম এই মিছিলের সাথে।
যাযাবরেরতো শেকড় থাকে না। যাযাবর কোথাও থিতু হতে পারে না। সোয়ালোর মত ফিরে যাওয়ার ডাক আসে এন্টার্কটিকা থেকে, সাইবেরিয়া থেকে অথবা দুই মেরু থেকে। আমিও কি ভেতরের ডাকে সাড়া দিয়ে ছেড়ে গেলাম এই অতিচেনা নগর? যে নগরীর প্রতিটি পথ আমি হেঁটেছি আমার সন্তানের সাথে। যে নগরীর প্রতিটি নেইবারহুড বা মহল্লায় ঘুরে ঘুরে আমার সন্তান বেড়ে উঠেছে, আমিও বেড়ে উঠেছি তার সাথে। সেই নগরও যে ছেড়ে যেতে হবে তাও কি ভেবেছিলাম! না ভাবিনি, চলে যাব অন্য কোথাও কিন্তু চলে আসলাম। তাহলে কি আমি হৃদয়ে বোহেমিয়ান কোনো পরিযায়ী পাখি? উড়তে উড়তে একদিন হারিয়ে যাব দিগন্ত ছাডিয়ে বনভূমির ওপাশে?

২০২১ এর মার্চে আমি যখন লস এঞ্জেলেস থেকে আটলান্টায় পাড়ি জমাই তখন আমার প্রবাস জীবনের ১৩তম বছর পার করেছি। তের বছর মানে চার হাজার সাত শত পঁয়তাল্লিশ দিন পার করেছি সুসভ্যতম এই নগরীতে অবগাহনে। পথে প্রান্তরে হেঁটে হেঁটে। কত মানুষ, কত স্মৃতি, কত কত রক্তহীন সম্পর্কের ইতিবৃত্ত তা তোলা থাক অন্য কোনোদিন অন্য কোনো চ্যাপ্টারের জন্য।

আটলান্টা আমেরিকার দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য জর্জিয়ার রাজধানী ও বৃহত্তম নগরী এবং আমেরিকার সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের বাণিজ্যিক প্রাণ কেন্দ্র। আটলান্টাকে বলা হয় ‘ক্যাপিটাল অব সাউদার্ন এম্পায়ার’ বা দক্ষিণ রাজত্বের রাজধানী। রাজনৈতিকভাব আটলান্টা তথা জর্জিয়া বরাবরই আমেরিকার একটা গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। ১৮৬৪ সালের আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় ইউনিয়ন আর্মির সাথে কনফেডারেট আর্মির গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ হয় এখানে। তখন সমগ্র আটলান্টা শহর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। পরে আবার গড়ে তোলা হয় এ নগরী। গত শতকের ষাটের দশকে এই আটলান্টাতেই গড়ে উঠেছিল আমেরিকা কাঁপানো সেই মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলন। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এর নেতৃত্বে হিউম্যান রাইটস মুভমেন্ট আমূল বদলে দেয় সমগ্র আমেরিকার সামাজিক প্রেক্ষপট।
বহু বহু বছর পরে ক্রমবিকশিত হতে থাকা এই আটলান্টায় এসেই আমি দেখা পেলাম সেই স্বদেশী মেঘের গুরুগম্ভীর গর্জন, অনর্গল ঝরে যাওয়া বৃষ্টি, বৃষ্টি আর বৃষ্টিভেজা কাঠ গোলাপের ছোঁয়া, ভেজা বাতাসে কাঁচা মাটির সোঁদা গন্ধ।
আমিও সেই লক্ষ্যহীন বহুযাযাবরের মত কান পেতে রই হৃদয়ের ডাক শোনার জন্য।

  • লেখক : আটলান্টা, জর্জিয়া প্রবাসী।
সম্পর্কিত পোস্ট