সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

লোকসানে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে কৃষক

হুমকির মুখে তেঁতুলিয়ার সমতলের চা শিল্প

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২২ | ৬:০৭ অপরাহ্ণ আপডেট: ২৫ মে ২০২২ | ৬:০৭ অপরাহ্ণ
হুমকির মুখে তেঁতুলিয়ার সমতলের চা শিল্প

দেশের চা শিল্পের বৃহত্তর তৃতীয় চা অঞ্চল এখন পঞ্চগড়। দেশের চা উৎপাদনে রেকর্ড ছাড়ালেও কাঁচা চা পাতার ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না কৃষকরা। প্রশাসন কর্তৃক মূল্য নির্ধারণ কমিটি পাতার দাম ১৮ টাকা নির্ধারণ করলেও সে দামে পাতা কিনছে না কারখানার মালিকরা। চাষিদের আগের দামেই ১১/১২ টাকায় পাতা বিক্রি করতে হচ্ছে।

এতে করে বর্তমানে রাউন্ডে রাউন্ডে গুনতে হচ্ছে লোকসান, লোকসান গুনতে গুনতে নি:স্ব হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এরকমই অভিযোগ চাষিদের। তাদের অভিযোগ, গভীর সিন্ডিকেটের কারণেই কারখানার মালিকরা কৃষকদের অল্প দামে পাতা বিক্রি করতে বাধ্য করাচ্ছেন। এতে প্রতি রাউন্ডে কৃষকদের গুনতে হচ্ছে লাভের জায়গায় লোকসান। চরম হতাশার পরিস্থিতিতে চাপা কান্নায় কাঁদছেন কৃষকরা। এভাবে চলতে থাকলে হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে দেশের তৃতীয় চা অঞ্চলের সমতলের চা শিল্প।

চাষিদের অভিযোগ, কারখানাগুলো আমাদের কাছ থেকে কম দামে চা পাতা সরবরাহ করে উৎকৃষ্টমানের পাতায় উৎপাদিত চা নিলাম বাজারে না দিয়ে গোপনে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে চোরাই পথে বিক্রি করা হচ্ছে। আর খারাপ পাতা দিয়ে চা উৎপাদন করে অকশন মার্কেটে তুলে চায়ের মান খারাপ এনে কৃষকদের ঠকানো হচ্ছে। চায়ের দাম নেই, অকশন মার্কেটের অবস্থা খারাপ অভিযোগ টেনে ১১/১২ টাকায় পাতা কিনছে। বিভিন্ন অজুহাতে পাতা ২৫-৫০% পর্যন্ত কেটে নিয়ে বাড়তি মুনাফা করছে কারখানার মালিকরা। আর প্রতি রাউন্ডে ব্যাপক লোকসান গুনতে হচ্ছে চাষিদের।

বাগান সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্রিটিশ নীলকরদের মতোই চা চাষিদের রক্ত চোষণ করছেন তারা। ১ হাজার কেজি কাঁচা চা পাতা কারখানায় নিলে সেখানে শতকরা ৫০ ভাগ বিভিন্ন অজুহাতে কেটে নিচ্ছে। ৫০ ভাগ পাতা ১২ টাকা বিক্রি করলে যা আসে, তা থেকে প্রতি কেজিতে লোকসান গুনতে হয় ৩-৪ টাকা। একদিকে কর্তনের ৫০ ভাগ লোকসান, অন্যদিকে ৫০ ভাগ বিক্রিতেও লোকসান। দ্বিগুন লোকসানে নি:স্ব হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ক্ষুদ্র চাষিদের।

আজিজনগর গ্রামের মিলন খানসহ কয়েকজন সময়ের সংলাপকে জানান, পাতার দাম না থাকায় লোকসান গুনতে হচ্ছে। এক কেজি কাঁচা চা পাতায় উৎপাদন খরচ হয় প্রায় ১৪/১৫ টাকা। কিন্তু কারখানা মালিকরা চা পাতা কিনছে ১১/১২ টাকায়। কারখানার মালিকরা চরম সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। এখন কারখানায় পাতা নিয়ে গেলে পিকআপ প্রতি ২ হাজার টাকা বলছে। কোন কোন চাষি বাধ্য হয়ে দিয়ে দিচ্ছে। চাষিদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে কারখানাগুলো। তারা কারখানায় পাতা নিলে ফিফটি পার্সেন্ট কেটে নিয়ে সে পাতায় বাড়তি মুনাফা আয় করছে, আর আমরা কৃষকরা চরম লোকসান গুনতে গুনতে নি:স্ব হয়ে যাচ্ছি।

শালবাহান এলাকার চা চাষিরা তরিকুল ইসলাম সময়ের সংলাপকে জানান, কারখানায় ন্যায্যমূল্যে পাতা বিক্রি করতে পারছি না। এক একর জমিতে চা বাগান করে চলতি তিন রাউন্ডে ৫০ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। সামনের পরিস্থিতি ভয়াবহ দেখছি। ব্রিটিশ নীলকরদের মহা রক্তচোষার মতো কারখানাগুলো কৃষকদের স্বপ্ন চুষে নিয়ে তারা লাভবান হচ্ছে। বাগানের পাতা বড় হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু দাম না থাকায় বাগানের পাতা বাগানেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কী করবো বুঝতে পারছি না। এরকম অভিযোগ তেঁতুলিয়া উপজেলার হাজার হাজার চা চাষির। চায়ের পাতার ন্যায্য মূল্য পেতে চলতি ১১ মে তেঁতুলিয়ায় ও পরে পঞ্চগড়ে মানববন্ধন করে চাষিরা। কিন্তু কিছুতেই কাজ না হওয়ায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, তেঁতুলিয়ায় ১ হাজার ২শত ৯০ হেক্টরের বেশি জমিতে গড়ে উঠেছে চা বাগান। নিবন্ধিত ক্ষুদ্র চা বাগান রয়েছে ১ হাজার ১ শ ৬৮ টি। অনিবন্ধিত চা বাগান রয়েছে ৬ হাজার। ১৪ টিরও বেশি গড়ে চা কারখানা গড়ে উঠলেও চা পাতার দাম না পাওয়ায় হতাশায় রয়েছেন প্রান্তিক চাষিরা। এ অঞ্চলে চা চাষে ঝুঁকে বন্ধ হয়ে গেছে আখ চাষ থেকে কয়েকটি কৃষি আবাদ। এখন দু’কূলই হারানোর পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে।

তবে কারখানার মালিকদের অভিযোগ, নিলাম বাজারে চায়ের দরপতন, মানসম্পন্ন চা পাতা সরবরাহ না করায় ক্ষতির মুখে পড়ছেন তারা। চায়ের নিলাম বাজার যখন ভালো ছিল তখন ২৪ থেকে ২৫ টাকা কেজিতে চা পাতা কিনেছেন তারা। বর্তমানে নিলাম বাজারে সিলেটের চা থেকে পঞ্চগড়ের চায়ের মান নিম্ন। ‘দুটি পাতা একটি কুড়ি’ এই নীতি না মেনে বাগান থেকে চা পাতা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ কারণে মানসম্পন্ন চা উৎপাদনে ব্যর্থ হচ্ছেন তারা। এজন্য নতুন নির্ধারিত দামেও চা পাতা কিনতে পারছেন না মালিকরা।

গ্রিন কেয়ার চা কারখানার ম্যানেজার মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু সময়ের সংলাপকে বলেন, চাষিরা নিয়ম মেনে পাতা না উত্তোলন করায় দাম পাচ্ছেন না। নিয়ম হচ্ছে এক কুঁড়ির তিন পাতা পর্যন্ত। কিন্তু এখানকার চাষিরা ৪-৮ পাতা পর্যন্ত নিয়ে আসছে কারখানায়। যার কারণে চায়ের মান খারাপ হলে মূল্য হ্রাস ঘটছে। বাগান থেকে নিয়মমত পাতা কেটে কারখানায় আনলে কৃষক নতুন নির্ধারিত ১৮ টাকাই পাবে বলে জানান তিনি।

জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম সময়ের সংলাপকে জানান, দেশের অন্যতম চা শিল্পের বৃহত্তম অঞ্চল হিসেবে চা উৎপাদনকারি ক্ষুদ্র চা চাষিদের স্বার্থের বিষয়টি আমাদের ভাবতে হবে। এ জন্য গত ১৮ মে জরুরী সভার মাধ্যমে চা পাতার মূল্য ১৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

সম্পর্কিত পোস্ট