শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

সময়ের সংলাপ, একজন এহতেশাম ও বিবর্ণ দশটি বছর

প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১২:৫৩ পূর্বাহ্ণ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১২:৫৪ পূর্বাহ্ণ
সময়ের সংলাপ, একজন এহতেশাম ও বিবর্ণ দশটি বছর

সময়টা ২০০৫ সাল, সংযুক্ত আরব আমিরাতে পা রাখার পর চারদিক কেমন জানি শুনশান মনে হচ্ছিল। অনেকটা বন্ধুহীন অবস্থায় পড়ে গেলাম। চট্টগ্রামের বহুল প্রচারিত দৈনিক পূর্বকোণ ও ঢাকার প্রভাবশালী পত্রিকা ইত্তেফাকের পাতায় পাতায় নিজের সাজানো ক্রাইম রিপোর্টগুলো চোখের সামনে দারুণভাবে ভেসে উঠছিল। মনে মনে ভাবছিলাম সেসময় নিজের অজান্তে কতখানি দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলাম। সংবাদের খোঁজে, সংবাদের পেছনে দাপিয়ে বেড়ানোর বিষয়গুলো আমাকে বারবার খোঁচা দিয়ে যাচ্ছিল। এইসব ছেড়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাড়ি দেওয়ার বিষয়টি তখন আমাকে প্রচন্ড কষ্ট দিচ্ছে। মনে হচ্ছিল, আমি কেমন জানি একাকী হয়ে পড়েছি। দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম।

আমিরাতে যাওয়ার পূর্বে দুইজন মানুষকে চিনতাম। একজন হচ্ছেন তখনকার দৈনিক পূর্বকোণের আরব আমিরাত প্রতিনিধি সাইফুল ইসলাম তালুকদার। অপরজন ফ্রিল্যান্সার সাংবাদিক নাসিম উদ্দিন আকাশ। আমি আমিরাতে যাওয়ার পরপরেই দুবাই ফেস্টিভ্যাল উপলক্ষে সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম তালুকদার দৈনিক পূর্বকোণ থেকে একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশ করলেন। ক্রোড়পত্র প্রকাশনায় দুবাই ফেস্টিভ্যালে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ থেকে আগাত দৈনিক পূর্বকোণের তৎকালীন মফস্বল সম্পাদক কলিম সারোয়ার। সেই সুবাদে দাওয়াত পেলাম এই অনুষ্ঠানে যাওয়ার। যেহেতু আমার পৈতৃক ব্যবসা আল আইনে, সেই সূত্রে আমি আল আইনে অবস্থান করছিলাম। সেখান থেকে আমি দুবাই আসার জন্য ইচ্ছা পোষণ করলে সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম তালুকদার আমাকে আল আইন পুলিশে কর্মরত নাসের উল্লাহ নাসের ভাইয়ের গাড়িতে করে দুবাই আসতে বলেন। ওনার কথা মতো আমি নাসের ভাইয়ের গাড়িতে দুবাই আসলাম।

এ অনুষ্ঠানে এসে বাংলাদেশ কমিউনিটির বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে আমার পরিচয় ঘটে। সেখানেই পরিচয় হয় দুবাইয়ের সেই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সংগঠক এহতেশামের সাথে। যাকে তুলে ধরার জন্য আজকের এই লেখা। সেসময় আরেক সাংস্কৃতিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ইঞ্জিনিয়ার আবু নাসের চৌধুরী সাথেও পরিচিত হই। মূলত এহতেশামের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।

চট্টগ্রামের সাংবাদিক জগতের অন্যতম নক্ষত্র কলিম সরোয়ার ছিলেন আমার সাংবাদিকতার শিক্ষক। ফলে কলিম সরোয়ার বিদেশের মাটিতে আমাকে পেয়ে খুব খুশী হলেন। আমিরাতের বাংলাদেশ কমিউনিটির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাকে সাথে নিয়ে গেলেন।এসব অনুষ্ঠানে ওনি প্রধান অতিথি আর আমি অতিথি বক্তা হিসেবে হাজির হলাম। সেই অনুষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ কমিউনিটির সাথে আমাকে দ্রুত পরিচয় হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।

একে একে পরিচয় হলো প্রগতিশীল সাংবাদিক দিদার আশরাফী, দুবাই এমিরেটস গোল্ডের কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ, তৎকালীন রাস-আল-খাইমা বাংলাদেশ ইসলামিয়া স্কুলের শিক্ষক ইয়াসিন সেলিম, রাস আল খাইমার কমিউনিটি নেতা তাজুউদ্দীন, হাফেজ মোহাম্মদ আজম, আল আইনের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ এহসানুল করিম, বিদা জাহিদের ব্যবসায়ী মোঃ শাহাবুদ্দিন, রাশেদ টাইপিংয়ের স্বত্বাধিকারী হাসান মোরশেদ, খোরশেদুল আলম, আবুধাবির সনজিৎ শীল, সংগঠক ও সাংস্কৃতিকর্মী বেলায়েত হোসেন হিরো, নাজিম উদ্দিন, দুবাই বঙ্গবন্ধু পরিষদের তৎকালীন সভাপতি আলমগীর জামানসহ অনেকে। নানা অনুষ্ঠানমালা শেষ করে কলিম ভাই দেশে চলে গেলেন। তবে কমিউনিটিতে আমার অবস্থানের একটি ভিত্তি তৈরি করে দিয়ে গেলেন। এই পরিচয়ের ধারাবাহিকতায় আমি উৎসাহ খুঁজে পেলাম সংবাদপত্র নিয়ে কাজ করার। স্বপ্ন দেখা শুরু হলো- সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাটিতে কিভাবে একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করা যায়!

হঠাৎ একদিন ফোন পেলাম রাস আল খাইমাহ বাংলাদেশ স্কুলের শিক্ষক ইয়াসমিন সেলিমের। ওনার সাথে ছিলেন হাফেজ মোহাম্মদ আজম ভাই। প্রস্তাব করলেন একটি সংবাদপত্র প্রকাশের। আরব আমিরাতে বাংলাদেশি গণমাধ্যমে কাজ করা সকলকে আমন্ত্রণ জানানোর উদ্যোগ নেওয়া হলো। এই প্রসঙ্গে সভা করার জন্য স্থান নির্ধারণ করা হলো দুবাইস্থ আল নাহাদায় এহতেশামের অফিসে। সকলে উপস্থিত হলাম সেখানে। এই এহতেশামের অফিসে ধরতে গেলে ‘সময়ের সংলাপ’ এর জন্ম। এই সভায় আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় সম্পাদনার। প্রধান সম্পাদক হিসেবে সকলে মিলে সম্মানিত করলাম চট্টগ্রামের প্রথিতযশা সাংবাদিক কলিম সরোয়ারকে। নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় হারুনুর রশিদকে। আবাসিক সম্পাদক হিসেবে দিদার আশরাফীকে, বার্তা সম্পাদক হাফেজ মোহাম্মদ আজমকে, সহযোগী সম্পাদক হিসেবে ইয়াসিন সেলিমকে, সহকারি সম্পাদক হিসেবে এহতেশামুল হককে, বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে তাজউদ্দীনকে, সহ সম্পাদক নাসিম উদ্দিন আকাশসহ আরো একঝাঁক উদীয়মান সংবাদকর্মী। তাদের নিয়ে ‘সময়ের সংলাপ’ এর যাত্রা শুরু হয়। সম্পাদনা পরিষদের ১০ জন ২ হাজার দিরহাম করে বিনিয়োগ করলাম পত্রিকার জন্য। বিনিয়োগকৃত ব্যক্তিদের একটি কমিটি করা হলো। এই কমিটির চেয়ারম্যান করা হয় আলী আকবর হারুনকে। বাংলাদেশে অফিসিয়াল সম্পাদনার দায়িত্ব ছিলেন তৎকালীন পূর্বকোণের স্টাফ রিপোর্টার খোরশেদুল আলম শামীম, তৎকালীন পূর্বকোণের সাব এডিটর আশরাফ উল্লাহ রুবেল, কালের কণ্ঠের সহ-সম্পাদক মামুনুর রশিদ। এখানে ‘সময়ের সংলাপ’র সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলাম এতেশামের সাথে ‘সময়ের সংলাপ’র বন্ধনটা বোঝানোর জন্য। ‘সময়ের সংলাপ’ থেকেও এহতেশামের বড় পরিচয় ছিল প্রবাসী বাংলাদেশিদের অন্যতম সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম ‘বাঁধন থিয়েটার’।

২০০৫ সালে সম্ভবত ডিসেম্বর মাসে দেরা দুবাইয়ের পুরাতন কনস্যুলেটের পাশে বাংলাদেশ ইসলামিয়া স্কুলের মঞ্চে সর্বপ্রথম বাঁধন থিয়েটারের পরিবেশনায় নাটক দেখার সুযোগ হয়। নাটকের পোশাক পরিচ্ছেদ, আবহ সংগীত, মূল চরিত্রে অভিনয়সহ সবকিছুতে দেখা গেল এহতেশামের আধিপত্য। তার অভিনয় দক্ষতা দেখে সত্যি মন জুড়িয়ে গেল। বাঁধন থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদকও ছিল এই এহতেশাম।থিয়েটারের সভাপতি ছিলেন প্রয়াত সাংস্কৃতিক সংগঠক মাহামুদুল হক চৌধুরী। এই দুইজনের নেতৃত্বে বাঁধন থিয়েটার পুরো আমিরাত জুড়ে বাংলা সংস্কৃতির মেলবন্ধন তৈরি করেছিল। মূলত এই সংগঠনের মাধ্যমে প্রবাসীদের মাঝে বাংলা সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, ২৬ শে মার্চ, পহেলা ফাল্গুন, বসন্ত উৎসব, বাংলা মেলা, ১৬ ডিসেম্বরসহ এমন কোনো বড় অনুষ্ঠান ছিল না যেখানে এহতেশাম বা বাঁধন থিয়েটারের উপস্থিতি নেই। টগবগে তারুণ্যের উন্মাদনা দিয়ে দেশপ্রেম নিয়ে দ্রুতগতিতে এহতেশাম যেন ছুটে চলছিল। সেই সাথে ছুটে চললো থিয়েটারের একদল সাংস্কৃতিক উন্মাদনায় নিজেদের উজার করে দেওয়া সহ-শিল্পীবৃন্দ। যাদের অনেকেই এখন বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন ।এসব সহ-শিল্পী বা কলাকুশলীর মধ্যে যারা ছিলেন তাদের অনেকের নাম মনে না থাকলেও যেসব ব্যক্তির নাম এখনও মনে পড়ে, বিশেষ করে আলী আকবর হারুন, আব্দুল মজিদ, গিয়াস উদ্দিন, আনোয়ার হোসেন, নাজমা জর্জ, শ্রাবণী আক্তার, জামাল উদ্দিন, মোহাম্মদ শাহাদাত, মোহাম্মদ ইউনুস, মোহাম্মদ ইলিয়াস, এমএকাশেম উল্লেখযোগ্য।

২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনটি প্রবাসের মাটিতে বেশ কয়েকটি সাড়া জাগানো নাটকের জন্ম দিয়েছে। যেই নাটকগুলোর কাহিনী চিত্রায়ন এখনও আমিরাত প্রবাসীদের স্মৃতিতে দাগ কাটে। বাঁধন থিয়েটারের যেসব নাটক আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, তা হলো- সু-বচন নির্বাসন, ক্রসফায়ার, ওরা কদম আলী, কৈশল্য পাহাড় উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশি সংস্কৃতি নিয়ে বাঁধন থিয়েটারের ব্যাপক অবদান থাকায় ২০০৪ সালের শারজায় অনুষ্ঠিত চ্যানেল আই পারফরম্যান্স আওয়ার্ড লাভ করেন এই সংগঠন। পাশাপাশি এই অনুষ্ঠানে সংক্ষিপ্ত একটি গীতিনাট্য উপস্থাপন করেন বাঁধন থিয়েটারের সদস্যরা। এ ছাড়াও ২০০৫ থেকে ২০১০ পর্যন্ত বাংলাদেশি সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্য নিয়ে দুবাইতে বাংলা মেলার আয়োজন করেন তারা।

সব কিছুই যেন ঠিকঠাক চলছিল। পরস্পরের প্রতি সম্প্রীতি, দেশীয় সংস্কৃতির প্রসার যেন বাংলাদেশ কমিউনিটি দারুণভাবে উপভোগ করতে লাগলো। মাঝেমধ্যে এহতেশাম শারজা মামজার পার্কে বারবিকিউর আয়োজন করত। সেখানে অনেকে আসতেন । বাঁধন থিয়েটারের কোনো পরিবেশনায় পারফর্ম করতে না পারলেও বারবিকিউ আয়োজনে মনের অজান্তে গলা ছেড়ে কত গান গেয়েছি তার কোনো হিসাব নেই। এহতেশাম নামে এ সুদর্শন পুরুষটির বন্ধুসুলভ আচরণ মানুষকে যে কত বিনোদন দিতো তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

(চলবে)

সম্পর্কিত পোস্ট