শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

যেভাবে রাশিয়ার কনসার্ট হলে সন্ত্রাসীরা হামলা চালালো

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২৪ | ৫:০৩ অপরাহ্ণ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২৪ | ৫:০৩ অপরাহ্ণ
যেভাবে রাশিয়ার কনসার্ট হলে সন্ত্রাসীরা হামলা চালালো

মস্কোর ক্রোকাস সিটি কনসার্ট হলে শুক্রবারের হামলা ছিল বহু বছরের মধ্যে রাশিয়ায় সবচেয়ে ভয়াবহ হামলার ঘটনা। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পঞ্চম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব শুরুর পর কমপ্লেক্সের ভেতর ঢুকে বন্দুকধারীদের হামলা চালানোর এই ঘটনায় ১৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া ইসলামিক স্টেট গ্রুপ (আইসিস) এই হামলার দায় স্বীকার করেছে।

কীভাবে হামলার ঘটনাটি হলো

ক্রোকাস সিটি হলটি মস্কোর শহরতলীতে এবং ক্রেমলিন থেকে বার মাইল দূরে। শুক্রবার সন্ধ্যায় বন্দুকধারীরা যখন হামলা শুরু করে তখন সেখানে রক গ্রুপ পিকনিকের একটি কনসার্ট চলছিল। ভিডিওতে দেখা যায় কনসার্ট হলে ঢোকার আগে থেকেই কমপক্ষে চারজন এলোপাথাড়ি গুলি করছে।

একজন নারী বলছিলেন যে যখন গুলির শব্দ শোনা যায় তখন মিলনায়তনের ভেতরে তিনিসহ অন্যরা মঞ্চের দিকে এগুচ্ছিলেন।

আমি অস্ত্রসহ এক ব্যক্তিকে দেখলাম একটি স্টলে এবং সে সময় গোলাগুলি হচ্ছিলো। তখন আমি হামাগুড়ি দিয়ে একটি লাউডস্পিকারের পেছনে লুকানোর চেষ্টা করি, তিনি বলছিলেন রাশিয়ার একটি টিভিকে।

এক পর্যায়ে হলের ভেতরে আগুন ধরিয়ে দেয়া যায়। আগুন পরে সামনের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে সাত তলা ভবনের ওপরের দুই তলার কাঁচ উড়ে যায়।

রাশিয়ার তদন্ত কমিটি বলেছে, সন্ত্রাসীরা কনসার্ট হল প্রাঙ্গণে আগুন দেয়ার জন্য দাহ্য জাতীয় তরল পদার্থ ব্যবহার করেছে। সেখানে দর্শকরা ছিল, যাদের অনেকেই আহত হয়েছে। পরে হেলিকপ্টার এনে ১৬০ টন পানি দেয়া হয়েছে কিন্তু তারপরেও আগুন পুরোপুরি নেভাতে দশ ঘণ্টার মতো সময় লেগেছে। এর মধ্যে সন্দেহভাজনরা সরে পড়ে। পুরো হামলার ঘটনাটি ছিল বিশ মিনিটের মতো। এতেই নিহত হয়েছে ১৪৩ মানুষ এবং আহত হয়েছে আরো অনেকে। অনেকেই নিহত হন গুলিতে। আর কিছু নিহত হন ধোঁয়ায় শ্বাসরোধ হয়। তবে পিকনিক ব্যান্ডের সদস্যরা অক্ষত রয়েছেন।

ক্রোকাস সিটি হল ভিকটিম কারা

প্রায় ছয় হাজার রাশিয়ান ওই ইভেন্টের জন্য কনসার্ট হল কমপ্লেক্সে ছিলেন। মৃতের সংখ্যাও ঘটনার পর ক্রমাগত বেড়েছে।

এখন পযর্ন্ত মৃতের সংখ্যা ১৪৩ জন বলে নিশ্চিত করেছে রাশিয়ার বিভিন্ন গণমাধ্যম। হতাহতের যে সরকারি তালিকা সেখানে সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তির বয়স ৭০ এর বেশি। ওই নারী তিন সন্তানসহ মারা গেছেন। নিহতদের পাশাপাশি কমপক্ষে আরো ৬০ জনের অবস্থা গুরুতর। নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে দেশটির কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, নিহত ও আহতদের অনেকেই এসেছিলেন ক্রাসনোগর্স্ক, খিমকি এবং নিকটবর্তী মস্কোর উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় আরো কয়েকটি শহর থেকে।

আগুন ও বিস্ফোরণ

ঘটনাস্থলে থাকা এক সাংবাদিক বলেন, গ্রেনেড অথবা বোমা থেকে অগ্নিকাণ্ড শুরু হয়। মুহূর্তের মধ্যে পুরো কনসার্ট হল যেন আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হয়। উদ্ধারকারী দল ও জরুরি সেবা সংস্থাগুলো সারা রাত ধরে উদ্ধারকাজ চালায়।

কালো ধোঁয়ায় আকাশ ছেয়ে যায়। ক্রোকাস সিটি হলে বেজমেন্টে থাকা ও ছাদে আশ্রয় নেওয়া দর্শকদের উদ্ধার করতে চেষ্টা করে যাচ্ছিল রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী।

ঘটনাস্থলে ছিলেন এএফপির এক সাংবাদিক। তিনি ছাদ থেকে কালো ধোঁয়া বের হতে দেখেছেন। আগুনের লেলিহান শিখা কীভাবে পুরো কনসার্ট হলে ছড়িয়ে পড়ে, তার বর্ণনা দিয়েছেন। রাশিয়ার গণমাধ্যম বলেছে, কনসার্ট হলের ছাদটি আংশিকভাবে ধসে পড়েছে।

শত শত পুলিশ ও দাঙ্গাবিরোধী স্কোয়াড বাহিনী ক্রোকাস সিটি হল বন্ধ করে দেয়। ক্রোকাস সিটি হলের কাছে বেশ কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশের গাড়ি এসে পৌঁছায়। অন্তত তিনটি হেলিকপ্টার ক্রোকাস সিটির ওপরে চক্কর দেয়।

রাশিয়ার জরুরি পরিস্থিতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলেছে, এখনো ছাদে আটকা মানুষদের উদ্ধারে অভিযান চলছে। কনসার্ট হলের বেজমেন্ট থেকে প্রায় ১০০ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।

এ হামলার দায় আইএস নিলেও হামলাকারীদের উদ্দেশ্য ও পরিচয় জানা যায়নি। উগ্রবাদীরা এর আগে রাশিয়ার বিচ্ছিন্ন অঞ্চলকে সমর্থন করার জন্য হামলা চালিয়েছে।

হামলাকারীরা কারা

রাশিয়ান এমপি অ্যালেক্সান্ডার খিনশটেইন বলেছেন হামলাকারীরা একটি সাদা রংয়ের রেনল্ট গাড়ীতে করে পালিয়ে যায়।

তিনি জানান পুলিশ ব্রিয়নস্ক অঞ্চলে গাড়িটি থামাবার চেষ্টা করেছিল, যেটি মস্কো থেকে ৩৪০ কিলোমিটার দূরে। সেখান থেকে দুজনকে আটক করা গেলেও বাকিরা পালিয়ে যায়।

গোলাগুলি শুরুর ১৪ ঘণ্টা পর রাশিয়ার ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস (এফএসবি) ১১ জনকে আটক করার কথা ঘোষণা করে, যাদের মধ্যে ‘চার জন সরাসরি জড়িত’। তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। তবে রাশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন এরা বিদেশি নাগরিক।

অসমর্থিত সূত্রগুলো এসব ব্যক্তিদের তাজিকিস্তানের নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করেছে। মি. খিনশটেইন বলেছেন, ওই দেশের পাসপোর্ট তাদের গাড়িতে পাওয়া গেছে।

হামলার পেছনে কারা

শুক্রবার এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে আইএস বলেছে তারাই এ হামলা চালিয়েছে। শনিবার মুখে মাস্ক পরিহিত চার হামলাকারীর ছবি তারা প্রকাশ করা করে। রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ এ দাবির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে মস্কোর বড় কোন সমাবেশে হামলা হতে পারে- যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে সতর্কতা দেয়ার দু সপ্তাহ পর এ দাবিটি এলো।

রাশিয়ান কর্মকর্তারা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে বিস্তারিত কোন তথ্য দেয়নি।

গত সপ্তাহে ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, রাশিয়ায় সম্ভাব্য হামলা সম্পর্কে কয়েকজন পশ্চিমা কর্মকর্তার উস্কানিমূলক বিবৃতি হলো ব্লাকমেইলিংয়ের মতো এবং ভয় দেখানো ও সমাজকে অস্থিতিশীল করার জন্য।

হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন।

যুক্তরাষ্ট্র যাদের চিহ্নিত করেছে তারা হলো আইএস-খোরসান বা আইএস-কে। সংগঠনটির উদ্দেশ্যে হলো আফগানিস্তান, পাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও ইরান জুড়ে মুসলিম খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা।

আইএস-কে রাশিয়ার ওপর দৃষ্টি দিচ্ছে গত দু বছর ধরে, নিউইয়র্ক ভিত্তিক বিশ্লেষক কলিন ক্লার্ককে উদ্ধৃত করে বলেছে নিউইয়র্ক টাইমস।

নিউইয়র্ক ভিত্তিক বিশ্লেষক কলিন ক্লার্ক বলেন, আফগানিস্তান, চেচনিয়া ও সিরিয়ায় মস্কোর হস্তক্ষেপের দিকে ইঙ্গিত করে আইএস-কে’র অভিযোগ হলো ক্রেমলিনের হাতে মুসলিমদের রক্ত।

তবে রাশিয়া কর্তৃপক্ষ আইএসের দাবির বিষয়ে কোন মন্তব্য করেনি। পুতিন বলেছেন ইউক্রেনের দিকে পালিয়ে যাওয়ার সময় হত্যাকারীদের আটক করা হয়েছে।

প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী সীমান্তে তাদের জন্য ইউক্রেনিয়ানরা একটি জায়গা তৈরি করছিল বলে জানান পুতিন। যদিও ইউক্রেন রাশিয়ার এ দাবি অসম্ভব বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।

সম্পর্কিত পোস্ট