মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রিসে অনিয়মিত বাংলাদেশিদের মানবেতর জীবনযাপন

প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২২ | ৫:১৬ অপরাহ্ণ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২২ | ১:৫১ পূর্বাহ্ণ
গ্রিসে অনিয়মিত বাংলাদেশিদের মানবেতর জীবনযাপন

প্রাচীন সভ্যতার দেশ গ্রিসে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অনিয়মিত বাংলাদেশি অভিবাসীরা। সম্প্রতি গ্রিক প্রশাসন বিশেষ অভিযান শুরুর পর থেকে অনেকটা গৃহবন্দি অবস্থায় রয়েছেন তারা। বের হলেই পুলিশি হয়রারির শিকার হতে হচ্ছে। এথেন্সে প্রতিদিনই চলছে অনিয়মিতদের ধরপাকড় অভিযান। বাংলাদেশিদেরকেই বেশি টার্গেট করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

অনিয়মিত অভিবাসীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতেও তোড়জোর শুরু করেছে সরকার। এরই মধ্যে ১৯ জনকে ফেরত পাঠানোর ঘটনায় আতঙ্ক বিরাজ করছে অভিবাসীদের মধ্যে। প্রাচীণ সভ্যতার পিঠস্থানখ্যাত এই দেশে বাংলাদেশিরা প্রতিনিয়তই বর্ণ-বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। তাদের দেখাশোনার যেন কেউ নেই।

বৃহত্তর সংগঠন ‘বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন গ্রিস’সহ রাজনৈতিক ও সামাজিক ছোট বড় বহু সংগঠন থাকলেও আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে নেই কেউ। ‘প্রবাসী অধিকার পরিষদ গ্রিস’ নামক একটি সংগঠনের তৎপরতা দেখা গেলেও অন্যান্য সংগঠনের নীরবতায় হতাশ প্রবাসীরা।

প্রতি বছরের মতো এবারও গত ১৯ মার্চ বিশ্ব বর্ণবাদীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আন্দোলনে মাঠে নামেন গ্রিসে বসবাসরত বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসন প্রত্যাশীরা। এতে বিশ্বের সকল অভিবাসন প্রত্যাশীদের সঙ্গে মানবতার ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলনে অংশ নেন হাজারও প্রবাসী বাংলাদেশি। গ্রিসের রাজধানী এথেন্সের ওমোনিয়া স্কয়ার থেকে পথসভার মাধ্যমে বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু হয়ে সংসদ ভবন প্রদক্ষিণ করে।

গ্রিসের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনসহ অনেক বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোকেও এই মিছিলে অংশ নিতে দেখা গেছে। এই কর্মসূচিতে বাংলাদেশিদের পক্ষে ‘প্রবাসী অধিকার পরিষদ’ ও ‘বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন গ্রিস’ এর ব্যানার লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশ কমিউনিটির ৪-৫ জন ছাড়া কাউকে দেখা যায়নি।

এছাড়া বেশ কিছুদিন প্রবাসী বাংলাদেশিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, বাসায় চুরি-ডাকাতি, রাস্তায় প্রকাশ্যে চুরি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। কোনো বিচার পাচ্ছেন না তারা। গ্রিসে বসবাসরত বাংলাদেশিদের অনুরোধ দল-মত নির্বিশেষে সব সংগঠন একত্রিত হয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশিদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনসহ কর্মবিরতির মতো কার্যকরী কর্মসূচি পালন করলে হয়তো গ্রিক সরকারের টনক নড়বে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত সপ্তাহের আগে থেকে অভিযান শুরু হওয়ার পর তারা এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৫শত জনেরও বেশি আটক করে তল্লাশি চালিয়েছে। যার মধ্যে ৬শ জনেরও বেশি অনিয়মিত। যাদের বৈধ কাগজপত্র নেই। তাদের পুলিশ ডিপোর্টেশন সেন্টারে পাঠিয়েছে। আটকদের সিংগভাগই বাংলাদেশি।

গ্রিসে বসবাস করেন প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি। গ্রিক সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বৈধ অনুমতি নিয়ে দেশটিতে বসবাস করা বাংলাদেশিদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ হাজার। এর বাইরে অনেকে রয়েছেন যাদের বসবাসের অনুমতি নেই বা আশ্রয় আবেদন বাতিল হয়েছে। এমনকি অনেকেই এখনো আশ্রয় আবেদনের সুযোগ পাননি।

গ্রিসের পশ্চিম মানোলাদায় বাস করেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক। তারা মূলত গ্রিক কৃষিখামারের সঙ্গে জড়িত। স্ট্রবেরি ও জয়তুন, মাল্টাসহ কৃষির বিভিন্ন খামারেই তাদের কাজ। গ্রিসে বসবাসরত শ্রমিকরা গ্রিস ও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছেন। এমনকি করোনা মহামারির মধ্যেও তারা কঠোর পরিশ্রম করে গ্রিসের কৃষিতে অবদান রাখছেন। এছাড়া রাজধানী এথেন্সেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকরা।

একটি সূত্র বলছে, জুলাই ২০২১ থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সারা বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রেরণে গ্রিসের অবস্থান ১৯তম। ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে ৪র্থ। ২০২২ সালে এর চেয়ে দ্বিগুণ রেমিট্যান্স দেশে পাঠানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র আশাবাদ ব্যক্ত করে।

গ্রিসে এই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের গণহারে গ্রেফতারে কারোই যেন মাথা ব্যথা নেই। গেলো বছরের ডিসেম্বরে একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে গ্রিস থেকে ১৯ জন বাংলাদেশিকে ঢাকায় ফেরত পাঠানো হয়। সে সময় গ্রিসের অভিবাসী ও শরণার্থীবিষয়ক মন্ত্রী নোতিস মিতারাচি লাইভে এসে জানান, বাংলাদেশের সরকারের সহযোগিতায় পাঁচ বছর পর অনিয়মিত বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।

গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সুরক্ষার আওতায় যারা নেই তাদের ফেরত পাঠাচ্ছে গ্রিস। অনিয়মিত অভিবাসী ফেরত নিতে ঢাকা সহযোগিতা করায় বৈধপথে বাংলাদেশ থেকে গ্রিসে মৌসুমি কর্মী আনার সুযোগ তৈরি হবে বলেও জানান তিনি।

এরপরই চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নোতিস মিতারাচির ঢাকা সফরে দুই দেশের সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়।

গ্রিসের অভিবাসী ও শরণার্থী মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, এর মধ্য দিয়ে বছরে চার হাজার বাংলাদেশিকে মৌসুমি কাজের ভিসা দেবে গ্রিস। বাংলাদেশ থেকে গ্রিক মন্ত্রী ফিরে আসার পর থেকেই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন অনিয়মিতরা।

অনিয়মিত বাংলাদেশিদের গ্রেফতার আতঙ্ক নিয়ে অভিবাসী বিষয়ক সংবাদমাধ্যম ‘ইনফোমাইগ্রেন্টস’ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে উল্লেখ করা হয়, ইনফোমাইগ্রেন্টসের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে এথেন্সের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশি অভিবাসীদের গ্রেফতারের বিষয়ে তারা কোনো তথ্য পাননি।

একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা যতটুকু খবর পেয়েছি গ্রিক সরকারের পুলিশ এখানে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ ধরনের কার্যক্রমে বাংলাদেশিদের সংশ্লিষ্টতা নেই। কাজেই তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই। যেহেতু বাংলাদেশি অনেক অনিয়মিত অভিবাসী গ্রিসে থাকেন, তারাও হয়তো এই ধরপাকড়ের মধ্যে পড়েও যেতে পারেন।

দূতাবাস সূত্র জানিয়েছে, গ্রিসে মোট ৩০-৩৫ হাজার বাংলাদেশি রয়েছেন। এর মধ্যে বৈধভাবে অনুমতি নিয়ে বসবাস করছেন এমন সংখ্যা সাড়ে ১২ হাজার। দূতাবাসের এই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রায় ২৩ হাজার অনিয়মিত বাংলাদেশির মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৯ জনকে গ্রিস ফেরত পাঠিয়েছে। এটা প্রতীকী। ওরাও চায় না বাংলাদেশের অবৈধদের ফেরত পাঠাতে। কারণ এখানে অনানুষ্ঠানিক খাতে বিদেশি শ্রমিকের একটা চাহিদা রয়েছে। ওদের বছরে ১৫ হাজার শ্রমিক লাগে। তার মধ্যে চার হাজার বাংলাদেশ থেকে নেবে এমন চুক্তি হয়েছে।

এপ্রিলে সংসদে অনুমোদিত হলে এর প্রক্রিয়া শুরু হবে। বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকেও অনুরোধ করা হয়েছে, যেসব বাংলাদেশি অবৈধ হয়েছে তাদের পর্যায়ক্রমে নিয়মিত করার জন্য। ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলে গ্রিসের মন্ত্রীও আশ্বাস দিয়েছেন। এই বিষয়ে দূতাবাস নিবিড়ভাবে গ্রিস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। কিন্তু সংখ্যাটা এখানে এত বেশি যে তার ব্যবস্থাপনাটা অনেক জটিল।

এদিকে, গত ২২ মার্চ গ্রিক আশ্রয় ও অভিবাসন মন্ত্রী নটিচ মিতারাকিস অবৈধ অভিবাসন নিয়ে সংসদে বক্তব্য দেন। তিনি অবৈধ অভিবাসন মোকাবিলায় তাদের প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে বলেন, অনিয়মিত অভিবাসীদের চাপে যখন ইউরোপ ৫৭ শতাংশ প্রবাহ বৃদ্ধির সম্মুখীন হচ্ছে, তখন গ্রিস অনিয়মিত অভিবাসীদের প্রবেশে নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করেছে। গ্রিস প্রমাণ করেছে অনিয়মিত অভিবাসীদের জন্য দেশটি প্রধান প্রবেশদ্বার নয়।

তিনি বলেন, ২০১৯ সালে এই দেশে অনিয়মিত অভিবাসী প্রবেশের সংখ্যা ছিলো ৭২ হাজার ৪২০ যা ২০২১ সালে ৮ হাজার ৭৪৫। অর্থাৎ আমরা এটি কমিয়ে আনতে পেরেছি এবং হ্রাসের পরিমাণ ৮৮ শতাংশ দাঁড়িয়েছে।

মিতারাকিস বলেন, ইমিগ্রেশনের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম আমাদের দেশের অবৈধ অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করে হ্রাস করার পাশাপাশি এটিকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসব। আমরা লিগ্যাল অভিবাসন, সংস্কার, ডিজিটালাইজেশন পদ্ধতি সহজীকরণে বিনিয়োগ করছি। এগুলা সংসদের বিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

অবশেষে অভিবাসন ও আশ্রয় মন্ত্রী, বাংলাদেশের সঙ্গে করা কর্মী আনার চুক্তি ও এদেশে থেকে সকল অনিয়মিত অভিবাসীদের দেশে পাঠানোর ব্যাপারে অবহিত করে তিনি বলেন, অবৈধ অভিবাসনের বিপরীতে আমরা বাংলাদেশের সহযোগিতায় একটি স্মারক স্বাক্ষর করেছি যা আমরা শিগগিরই অনুমোদনের জন্য সংসদে জমা দেব।

‘আমরা আইনগত ও সংগঠিত উপায়ে অভিবাসনের একটি নতুন মডেল চালু করছি। তৃতীয় দেশের নাগরিকদের আইনগতভাবে কাজ করার অধিকার দেব। মৌসুমি ভিসায় বিভিন্ন দেশ থেকে চুক্তিভিত্তিক ১-৫ বছরের ভিসায় কর্মী আনব। তাদের বছরে ৯ মাস কাজ ও ৩ মাস বাধ্যতামূলক নিজ দেশে ছুটিতে যাওয়ার জন্য বলব।’

মন্ত্রী বলেন, গ্রিসে দীর্ঘমেয়াদি বাসস্থান, নাগরিকত্ব বা পারিবারিক পুনর্মিলনের অনুমতি ছাড়াই আইনিভাবে মৌসুমি ভিসার শ্রমিক এসে কাজ করে চুক্তি শেষ হলে নিজ দেশে ফেরত যাবে। সংসদে আমাদের প্রস্তাব পাশ হলে আমরা বাংলাদেশ থেকে চুক্তি অনুযায়ী মৌসুমি ভিসায় কর্মী আনবো। একই সাথে বাংলাদেশের যত অভিবাসী অবৈধভাবে আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে তাদের দ্রুত বহিষ্কারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সংলাপ-২৭/০৩/০০৯/আ/আ

সম্পর্কিত পোস্ট