মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

আমিরাতে রেকর্ড বৃষ্টিপাত, ‘ক্লাউড-সিডিং’র অভিযোগ অস্বীকার

প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৪ | ৭:৫৬ অপরাহ্ণ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২৪ | ৮:৪৮ অপরাহ্ণ
আমিরাতে রেকর্ড বৃষ্টিপাত, ‘ক্লাউড-সিডিং’র অভিযোগ অস্বীকার

ইফতেখার ইসলাম: শুষ্ক জলবায়ু ও উচ্চ তাপমাত্রার জন্য পরিচিত আরব আমিরাতে মুষলধারে বৃষ্টিপাতের কারণে হঠাৎ বন্যা দেখা দিয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) মধ্যপ্রাচ্যে দেশটিতে নজিরবিহীন বজ্রপাতসহ বৃষ্টি শুরু হয়। এতে নাগরিক জীবন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। আর এমন পরিস্থিতিতে ক্লাউড-সিডিং এর মাধ্যমে বৃষ্টিপাত ঘটানো হয়েছে বলে অনেকেই অভিযোগ করছেন। যদিও তা উড়িয়ে দিয়ে ন্যাশনাল সেন্টার অফ মেটিওরোলজি (এনসিএম)।

বুধবার (১৭ এপ্রিল) ন্যাশনাল সেন্টার অফ মেটিওরোলজির (এনসিএম) বরাত দিয়ে খালিজ টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মঙ্গলবার যখন সংযুক্ত আরব আমিরাত মুষলধারে বৃষ্টির সময় কোন ক্লাউড-সিডিং মিশন পরিচালিত হয়নি।

এনসিএম-এর ডা. আহমেদ হাবিব খালি বলেন, চরম আবহাওয়ার সময়, কোনও ক্লাউড-সিডিং করা হয় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমর বিভিন্ন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, এই সময়ের মধ্যে বীজ বপন অপারেশনের জন্য কোনও পাইলট পাঠানো হয়নি।

ক্লাউড-সিডিং না হলে রেকর্ড বৃষ্টির কারণ কী?

মঙ্গলবার কেন এত ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছিলো এসেছিল তা ব্যাখ্যা করে হাবিব বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওপর তৈরি হওয়া সংবহনশীল মেঘের উপস্থিতি আবহাওয়ার একটি সিরিজের সূত্রপাত করেছে।

আরব সাগর থেকে উদ্ভূত উষ্ণ, আর্দ্র বায়ু ওমান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের দিকে প্রবাহিত হচ্ছিল। একই সাথে উপরের বায়ুমণ্ডলে নিম্নচাপ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। তাই আর্দ্রতার মাত্রা সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওপর তীব্রতর হয়েছে। এটি সেই উষ্ণ বাতাসে প্রকৃত আর্দ্রতাকে ঘনীভূত করেছে। যা অস্থিতিশীল আবহাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হাবিব বলেন, এই অঞ্চলটি ৪টিরও বেশি আবহাওয়ার তরঙ্গের সম্মুখীন হয়েছে। সবচেয়ে তীব্র বিকাল থেকে শেষ রাত পর্যন্ত ঘটেছিল।

আবহাওয়া স্থিতিশীলের দিকে

আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ নিশ্চিত করেছেন, সবচেয়ে খারাপ সময় শেষ হয়ে গেছে। নিম্নচাপ ব্যবস্থা পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে শুরু করায় দেশে শুধুমাত্র হালকা বৃষ্টি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

হাবিব বলেন, আমাদের কাছে দেশের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ে মেঘের তথ্য রয়েছে যা শুধুমাত্র দুবাই এবং আবু ধাবি থেকে অনেক দূরে এই অঞ্চলে সামান্য বৃষ্টি আনবে।

এর ফলে সেখানে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত হবে। আজ রাত থেকে আমরা ধীরে ধীরে স্থিতিশীল আবহাওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আল আইন এবং আবুধাবির মধ্যে এবং আবুধাবি ও মদিনাত জায়েদের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের অভ্যন্তরীণ অংশে কুয়াশা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

ক্লাউড সিডিং কি?

ক্লাউড সিডিং হলো এমন এক কৌশল যেখানে ঘনীভবন প্রক্রিয়াকে উদ্দীপিত করতে এবং বৃষ্টিপাত বাড়াতে মেঘে রাসায়নিক উদ্দীপক এজেন্ট ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় আবহাওয়ার পূর্বাভাসদাতাদের বায়ুমণ্ডলীয় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও বৃষ্টিপাতের ধরনের ওপর ভিত্তি করে উপযুক্ত মেঘ শনাক্ত করা হয়।

সংযুক্ত আরব আমিরাত ১৯৮২ সালে প্রথমবারের মতো ক্লাউড সিডিং পরীক্ষা করে দেখে। ২০০০ দশকের গোড়ার দিকে উপসাগরীয় দেশটির কৃত্রিম বৃষ্টিপাত কর্মসূচি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোর ন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফেরিক রিসার্চ (এনসিএআর), দক্ষিণ আফ্রিকার উইটওয়াটারস্র্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং নাসার সঙ্গে সহযোগিতামূলক বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত গবেষণার সাহায্যে আরও জোরদার করা হয়।

আমিরাতের জাতীয় আবহাওয়া কেন্দ্রের (এনসিএম) পরিচালিত সংযুক্ত আরব আমিরাতের বৃষ্টিপাত বর্ধন কর্মসূচির (ইউএইআরইপি) আওতায় এই কর্মসূচি এগিয়ে নেওয়া হয়। এই কর্মসূচিতে জড়িত বিজ্ঞানীরা সংযুক্ত আরব আমিরাতের বায়ুমণ্ডলের ভৌতিক ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য, বিশেষত অ্যারোসল এবং দূষণ কণার মেঘ গঠনে প্রভাব বিশ্লেষণে বিশেষ গুরুত্ব দেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মেঘের বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করতে এবং শেষ পর্যন্ত বৃষ্টিপাত বাড়াতে একটি কার্যকর এজেন্ট শনাক্ত করা।

একবার উপযুক্ত মেঘ শনাক্ত হয়ে গেলে হাইগ্রোস্কোপিক ফ্লেয়ার দিয়ে সজ্জিত বিশেষ উড়োজাহাজ আকাশে পাঠানো হয়। উড়োজাহাজের পাখায় লাগানো এই ফ্লেয়ারগুলোতে লবণজাতীয় উপাদান থাকে। নির্দিষ্ট মেঘে পৌঁছানোর পরে ফ্লেয়ারগুলো ছোড়া হয়, যা বীজ বা সিডিং এজেন্টকে মেঘে ছড়িয়ে দেয়।

লবণের কণাগুলো নিউক্লেই হিসেবে কাজ করে, যার আশপাশে পানির কণা ঘনীভূত হতে থাকে। অবশেষে কণাগুলো বৃষ্টিপাত হিসেবে পড়ার জন্য যথেষ্ট ভারী হয়ে ওঠে।

প্রক্রিয়াটির বর্ণনায় ইউএইআরইপি বলে, ‘এনসিএম আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের জন্য ৮৬টি স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া স্টেশন (এডাব্লুওএস) এর একটি জাতীয় নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করেছে। এর মধ্যে ছয়টি আবহাওয়া রাডার পুরো সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করে এবং একটি ওপরের বায়ু স্টেশন পর্যবেক্ষণ করে। সেন্টারটি জলবায়ু ডাটাবেসও তৈরি করেছে এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে উচ্চ নির্ভুল নিউমেরিকাল ওয়েদার প্রেডিকশনস এবং সিমুলেশন সফটওয়্যার বিকাশে সহায়তা করেছে।’

এটি আরও বলে, ‘বর্তমানে, এনসিএম আল আইন বিমানবন্দর থেকে চারটি বিচক্রাফ্ট কিং এয়ার সি ৯০ বিমান পরিচালনা করে। এতে ক্লাউড সিডিং এবং বায়ুমণ্ডলীয় গবেষণার জন্য সর্বশেষ প্রযুক্তি এবং ডিভাইস নিযুক্ত করা হয়েছে।’

পরিবেশগত উদ্বেগ

ক্লাউড সিডিংয়ের মাধ্যমে কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের সম্ভাব্য সুবিধা সত্ত্বেও, এর পরিবেশগত প্রভাব এবং ব্যবহৃত বীজ এজেন্টগুলোর নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে এনসিএম এর অভিযানের নিরাপত্তা এবং স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে।

অন্যান্য কিছু দেশে ক্লাউড সিডিংয়ের জন্য স্ফটিকের মতো সিলভার আয়োডাইড ব্যবহার করা হলেও, যা পরিবেশগত উদ্বেগ তৈরি করেছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত কর্মসূচিতে ক্ষতিকারক রাসায়নিক ব্যবহার থেকে বিরত থাকে। এর পরিবর্তে দেশটি সিডিং এজেন্ট হিসেবে প্রাকৃতিক লবণ ব্যবহার করে।

এনসিএম ন্যানো উপাদান নামে পরিচিত নিজস্ব সিডিং এজেন্ট তৈরি করেছে। এর মধ্যে টাইটানিয়াম অক্সাইডের প্রলেপ দেওয়া সূক্ষ্ম লবণ রয়েছে। বৃষ্টিপাত বৃদ্ধিতে কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য বর্তমানে এ উপাদানটির ওপর নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা হচ্ছে।

এ ছাড়াও প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ব্যত্যয় ঘটানো নিয়ে অন্যান্য উদ্বেগও রয়েছে। এই অঞ্চলে ঝড় এবং ভারী বৃষ্টিপাতের মতো ব্যতিক্রমী আবহাওয়ার সম্মুখীন হওয়ার পাশাপাশি অভূতপূর্ব বন্যা দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ প্রাকৃতিক শৃঙ্খলায় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দাবি করছেন যে এই বন্যা প্রকৃতির প্রতিশোধ নেওয়ার একটি ধরন।

প্রসঙ্গত, সংযুক্ত আরব আমিরাত সোমবারের শেষ থেকে মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) রাত পর্যন্ত ৭৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। ১৯৪৯ সালে ডেটা সংগ্রহ শুরু হওয়ার পর থেকে যে কোনো রেকর্ড করা বৃষ্টিপাতকে ছাড়িয়ে গেছে এবারের বৃষ্টি। কোন কোন এলাকায় ২৫০ মিলিমিটারের  বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। আবহাওয়া বিভাগ আল আইনের খাতম আল শাকলা এলাকায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। ২৪ ঘন্টারও কম সময়ে ২৫৪ মিলিমিটারের বৃষ্টিপাত হয়েছে এই অঞ্চলে। এই সময়ে অন্তত ১ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া ওমানে নিহতের সংখ্যা ১৮’র বেশি।

সম্পর্কিত পোস্ট