নতুন জায়গা হাবসানে এসে এক মজার ঘটনা অবলোকন করলাম। এখানে সব জায়গার মতো তিন ধরণের মেস ‘হল’ আছে। একটি লেবার মেস। একটি জুনিয়র মেস, একটি সিনিয়র মেস। তিনটাতেই দেখলাম বাঙালি ভাইয়েরা কাজ করছে। আমি সিনিয়র মেস এর সদস্য। ওখানে খেতে গিয়ে দেখলাম দু’জন কর্মচারি স্বদেশী ভাই কথোপকথনে ব্যস্ত। চট্টগ্রামের ভাই তার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছে সিলেটের এক ভাইয়ের সাথে। আবার সিলেটের ভাই সিলেটী ভাষায় কথা বলছে চট্টগ্রামের ভাইটির সাথে। তাতে কোন সমস্যা ছিল না। যদিও বাংলাদেশের এই দুই অঞ্চলের ভাষা সবার পক্ষে পুরোটা বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু তারা আমাকে অবাক করেছেন পাকিস্তানি ও ভারতীয় লোকদের সাথেও তারা তাদের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। আর তারাও কোন রকমে বুঝে নিচ্ছেন। মজা পেলাম। এবং অনেকদিন আগে বলা এক বন্ধুর কথা মনে পড়ল। বন্ধুটি বলেছিলেন, তাদের কোম্পানিতে এক বাঙালি নতুন এসে তার পাকিস্তানি কলিগের সাথে বাংলায় আলাপ করছিল। কলিগটি বিস্মিত হলেও কোন রকম প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে তার কথা বোঝার চেষ্টা করছেন। এ সময় বন্ধুটি তাকে বলল, তুমি বাংলা বললে এ কি বুঝবে? দেশী ভাইটির উত্তর ছিল, আমার বলার দরকার ছিল তাই বলেছি, বোঝা-না বোঝা তার (পাকিস্তানি ব্যক্তিটির) ব্যাপার। হা-হা-হা-হা-হাসতে হাসতে আমি জল বিয়োগে ছুটলাম।
হাবসানের ক্যাম্পটি ছিল অনেক বড়। পায়ে হেটে গোটা ক্যাম্প এলাকা ঘোরা সবার পক্ষে সম্ভব না। আমার রুম থেকে আমাদের মেস এ যেতে হলে মিনিমাম ১০ মিনিট সময় লাগে। গরমের জন্য এই দশ মিনিটে ক্লান্তি বেড়ে যায় বেশ কয়েকগুণ। তাছাড়া ইন্ডিয়ান মেস এর খাবার মুখে নেয়া যায় না। সব মাটি মাটি লাগে। জানিনা খেতে না পারার জন্য কোন কেমিক্যাল ঢালে কিনা। খেতে না পেরে বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে খেতে হত। বছর খানিক সেখানে কষ্টে-ক্লেশে অতিবাহিত করে মদিনা জায়েদ (বিদা জায়েদ) ট্রান্সফার হলাম। এটা আমার প্রবাস জীবনের শেষার্ধের গল্প বলছি।
মদিনা জায়েদ এসে চারজনের শেয়ারিং রুম পেলাম। প্রশস্ত রুমের চারকোণায় চারটি বেড। রুম পার্টনার দেখে বুঝতে পারলাম চারদেশের চার ভাষা ও ভিন্ন ভিন্ন কালচারের লোকদের সাথে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে হবে। আমি বাঙালি মুসলমান, একজন পাকিস্তানি পাঞ্জাবি যে কিনা নিজেকে সবসময় ‘হামবড়া’একটা ভাব নিয়ে থাকে। কথায় কথায় গালি বকা পাকিস্তানি পাঞ্জাবিদের জন্মগত অভ্যাস। তৃতীয় জন পাকিস্তানি পাঠান। খুবই ভদ্র ও সহজ সরল নামাজি বান্দা। চতুর্থ জন ভারতের শিখ(সর্দার) সম্প্রদায়ের লোক। পাঠান ব্যতীত বাকি দুজন বয়সে আমার থেকে অনেক ছোট। শিখ তার শিয়রে লাল মার্কার পেন দিয়ে লিখে রেখেছে ‘জয়হিন্দ’। এদিকে পাকিস্তানি পাঞ্জাবিও কয়েকদিন পর সবুজ ঘাড় মার্কারে বড় বড় হরফে তার শিয়রে লিখে দিল ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। পাকিস্তান ভারতের
নিরপেক্ষভাবে আমার দেখা অভিজ্ঞতা শেয়ার করলে বলব, রেষারেষি তথা সাম্প্রদায়িকতার এই দুর্গন্ধ থেকে পাকিস্তান ও ভারতের কেউই মুক্ত নয়। তবে তুলনামূলক পাকিস্তানিরা আগ্রাসী বেশি। হাসতে হাসতেও আক্রমণাত্মক কথা বলা ঠাট্টার ছলে খোঁচা মারা এদের চরিত্র। আমাকে একদিন একবন্ধু বলল- তুমিও তোমার শিয়রে ‘জয় বাংলা’ লিখে দাও। আমি হেসে সেই বিদেশী বন্ধুকে বললাম-‘ জয় বাংলা’ এত সস্তা কোনো স্লোগান না। এই জয় বাংলার সাথে লেগে আছে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত, দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম ও লক্ষ লক্ষ বাঙালির অনাবিল স্বপ্ন। আমি পারি না আমার দেশ, পতাকা ও স্লোগানকে নিচে নামাতে। দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। আমার কথায় বন্ধুটি সহ তিন রুম ম্যাট চোখ গোল গোল করে তাকিয়েছিল আমার দিকে। আমার দীর্ঘ প্রবাসজীবনে পাকিস্তানিদের সাথে আমার নিত্য বাকযুদ্ধ হত। তারা কখনো ঠাট্টার ছলে আমার সামনে কখনও আমার পেছনে বলে বেড়াত ‘ইয়ে মুজিবর রহমান কা লোক হ্যাঁয়’ ( এটা মুজিবর রহমানের মানুষ)। রেষারেষি জানি সেই ৪৭’র আগে থেকে। কিন্তু সেটা যে জাতির মাঝেও এত প্রকটভাবে সংক্রমিত হবে তা না দেখলে বুঝতে পারতাম না।
সত্যি কথা বলতে কি- এতে আমি গর্ব অনুভব করতাম। ৭১’এ যুদ্ধে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। কিন্তু ৮৭ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত আমি পাকিস্তানিদের সাথে বাকযুদ্ধ করেছি প্রতিদিন। প্রবাসে থাকাবস্থায় পাকিস্তানিদের খুব কাছ থেকে দেখেছি। তারা মুখে মুখে খুবই ধর্মভিরু, খুবই ইসলাম প্রেমি কিন্তু তাদের আমল দেখলে অবাক হতে হয়। আমি তাদেরকে কখনোই ছেড়ে কথা বলতাম না। রাশেদিয়ায় পাকিস্তান মারকাজে একদা চৌদ্দ আগস্ট পাকিস্তান দিবস উপলক্ষে মেলা বসেছিল। আমাদের কোম্পানির স্টলের পাশেই আমাদেরই আমদানি করা বাংলাদেশি চা’র প্রচারণার জন্য মেলায় আসা লোকদেরকে ফ্রি চা টেস্ট করা হচ্ছিল। পাকিস্তানি সহকারী চিমা বশির পেরে উঠছিল না পাকিস্তানি লোকদের ভিড়ে। আমি তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসে বললাম-আপনারা একটু লাইনে দাঁড়ান। আমরা সবাইকে চা দেব। ভিড় থেকে একজন তার সাত/আট বছর বয়সী ছেলেকে চেঁচিয়ে বলল-বেটা কাপ ছিন কে লাও। পাকিস্তানি হাত দেখাও’ (পুত্র কাপ কেড়ে নাও, পাকিস্তানি শক্তি দেখাও)। শুনে আমি আর নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারলামনা। বললাম- বাচ্চা কো ইয়ে কিয়া ছিখারে। এয়ছে তালিম দেতা ? ইছমে মুল্লুক কা নাম রওশন হোগা ? (শিশুকে এটা কী শেখাচ্ছেন ? এরকম শিক্ষা দেন ?এতে দেশের মুখ উজ্জ্বল হবে )? আমার সাথে সাথে চিমা বশিরও বলে উঠলেন- এই বিদেশে তোমরাই পাকিস্তানের নাম খারাপ করছো। সাথে সাথে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানিও আমাদের কথাকে সমর্থন করলেও ধাক্কাধাক্কি আর বিশৃঙ্খলা সমান তালে বজায় রাখলো।
অনেকে আমাকে বলেন, আমি পাকিস্তান বিদ্বেষী। আসলে মোটেও তা নয়। আমি কখনো সব পাকিস্তানিকে খারাপ বলিনা। তবে অধিকাংশ খারাপ। বিশেষ করে পাঞ্জাবিরা। যারা ওদের কাছ থেকে দেখেনি তারা কখনোই বুঝতে পারবে না। এক লেখক বন্ধু ফেসবুকে পাকিস্তানিদের কাণ্ডকারখানা লেখায় খুব অসন্তুষ্ট হয়ে আমার সাথে বিতর্কে নেমে গেলেন। তিনিও নাকি দীর্ঘকাল বিদেশে ছিলেন এবং পাকিস্তানিদের সাথে মিশেছেন। আমি যতটুকু বলেছি তারা নাকি ততটুক খারাপ না। তার মতে তারা ধার্মিক, সাচ্চা মুসলমান। পরবর্তীতে বুঝলাম, তিনিও পাকি প্রেমে নাপাকি হওয়া এদেশের রাজনৈতিক গন্ধের বুদবুদ। তার নিকট তো পাকিস্তানির লাথিও নেয়ামত এর মত। ফেসবুকের বিতর্কে তিনি শেষ পর্যন্ত শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করায় আমি তাকে আনফ্রেন্ড করতে বাধ্য হয়েছিলাম। মজার ব্যাপার হল আনফ্রেন্ড করার পর গতবছর জিমনেশিয়াম ময়দানের বই মেলায় একটি স্টলে তার সাথে দেখা হয়েছিল। আমি এগিয়ে গিয়ে হাত মিলিয়ে কথা বলেছিলাম। তিনি চিনতে পেরেছিলেন কিনা জানিনা। এখনো আমি আফসোস করি একজন লেখকের ভেতর দেশপ্রেম থাকলে তিনি কী করে স্বাধীনতার শত্রুদের বন্ধু ভাবতে পারে।
আমার প্রথম কোম্পানিটা ছিল পাকিস্তানিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাই ভরপুর। যেখানে আমি চব্বিশ বছর তাদের সাথে কাজ করেছি, খেয়েছি, ঘুমিয়েছি। পাকিস্তানের পাঠান, বেলুচ, সিন্ধি, পাঞ্জাবি, মাকরানি, বিহারি ও মোহাজের সহ নানা জাতি-বর্ণের সাথে মিশেছি। পাঠানেরা ধার্মিক ও সহজ সরল তবে খুবই ইমোশনাল। সিন্ধিরা একটু চালাক ও পোশাক পরিচ্ছদে স্টাইলিস্ট। বিহারি খুব স্বার্থপর আর ধুর্ত। মাকরানি ঝগড়াটে, পাঞ্জাবিরা খুবই নোংরা, কথায় কথায় গালি দেয়া এদের স্বভাব। অশ্লীলতা তাদের জন্য কোন ব্যাপার না। মোহাজের তুলনামূলক শিক্ষিত, মার্জিত হলেও ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক। আমার এই বিশ্লেষণ বা পর্যালোচনা কোন গবেষণা থেকে নয়। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে। মনে রাখতে হবে প্রবাসেও কেউ কেউ অন্ধের হাতি দেখার মত প্রবাসজীবন দেখেছেন। যেমন কেউ প্রবাসে মরু অঞ্চলে কাজ করেন। সেখান থেকে বের হওয়ার সুযোগ পান না। দেশে এলে কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করে দুবাই দেখতে কেমন ? তিনি বলবেন-দুবাইতে কিছুই নেই। শুধু ধু ধু মাঠ, দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমি। আবার শহরে বাস করেন এমন প্রবাসীকে জিজ্ঞেস করলে, তিনি বলবেন- দুবাইতে নানা ডিজাইনের অত্যাধুনিক রঙিন কাঁচের বিল্ডিং ও দামি দামি গাড়ি, প্রশস্ত মসৃন সড়ক। যারা সমগ্র সংযুক্ত আরব আমিরাত দেখেছেন তাদের দেখার সাথে খণ্ডচিত্র দেখা লোকের সাথে পার্থক্য হল ট্রেইলার দেখা আর ফুল পিকচার দেখা দর্শকের মত।
- সাংবাদিক ও কলাম লেখক