বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

যুক্তরাষ্ট্রের গোল্ডেন জুবিলি বাংলাদেশ কনসার্ট

৯৫ শতাংশ জানেন না কনসার্টের কথা

প্রকাশ: ৬ মে ২০২২ | ৭:৩৭ অপরাহ্ণ আপডেট: ৬ মে ২০২২ | ৭:৩৭ অপরাহ্ণ
৯৫ শতাংশ জানেন না কনসার্টের কথা

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ঐতিহাসিক মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে স্থানীয় সময় শুক্রবার (৬ মে) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ‘গোল্ডেন জুবিলি বাংলাদেশ কনসার্ট’। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত এত বড় একটি আন্তর্জাতিক মানের কনসার্টের আয়োজন সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা ৯৫ শতাংশ বাংলাদেশি জানেন না। কনসার্টের কোনো প্রচারও চোখে পড়েনি। এ নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে ‘মেইন স্ট্রিম মিডিয়া’ নামক প্রতিষ্ঠান প্রকাশ্যে আসেনি। নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ১৫টি সাপ্তাহিক পত্রিকার মধ্যে মাত্র কমসংখ্যক প্রচারের তিন-চারটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছে। এসব বিজ্ঞাপনে কনসার্টের সময়সূচি, টিকিট সম্পর্কিত পর্যাপ্ত তথ্য নেই। এতে ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনের ঠিকানাও উল্লেখ করা হয়নি।

একদিন আগে নিউ ইয়র্ক কনস্যুলেটে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এই বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীদের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, প্রতিষ্ঠিত লেখক-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের বিনা মূল্যে প্রবেশের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও আওয়ামী লীগের কর্মীরাও বিনামূল্যে টিকিট পাবেন।

জানা গেছে, গত ৪ মে পর্যন্ত টিকিট বিক্রি ও বিতরণ করা হয়েছে মাত্র ৪ হাজার। অথচ ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনের মিলনায়তনের আসন সংখ্যা ২০ হাজার ৭৮৯টি। এ মিলনায়তনের এক দিনের ভাড়া প্রায় পাঁচ লাখ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা)।

শেষ মুহূর্তে এসে কনসার্টের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করায় প্রবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি মন্ত্রণালয় এর আয়োজন করেছে।

মুক্তিযুদ্ধকালে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট এই ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে জর্জ হ্যারিসন, পণ্ডিত রবিশঙ্করের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশ কনসার্ট’। এ কনসার্ট ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের জন্য। তাদেরই স্মরণে এ কনসার্ট।

জানা গেছে, এক বছর আগে এ কনসার্টের সময় নির্ধারণ করা হলেও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিরা ছিলেন সম্পূর্ণ অন্ধকারে। শুধু তাই নয়, কনসার্ট সম্পর্কে শেষ মুহূর্তে জানতে পেরেছে ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস ও নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল। বিশাল বাজেটের এ কনসার্ট উপভোগ করতে দেশ থেকে মন্ত্রী, এমপি, আমলা ও তাদের পরিবারের মোট ৫৫ জন সদস্য নিউ ইয়র্কে আসছেন বলে জানা গেছে।

বিদেশ যাওয়া সংক্রান্ত সরকারি আদেশে (জিও) দেখা যায়, এ আয়োজনে অংশ নিতে যাচ্ছেন সরকারের দুই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, তিনজন সংসদ সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা ও তাদের আত্মীয়স্বজনসহ ৫৫ জন। এদের মধ্যে আইসিটি বিভাগসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রকল্প ও দপ্তরের আছেন ৩১ জন।

এত কর্মকর্তা কেন যাচ্ছেন, কোন মাপকাঠিতে যাচ্ছেন, তাদের কার কী দায়িত্ব, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বিকর্ণ কুমার ঘোষ দাবি করেন, যারা যাচ্ছেন, সবারই ভূমিকা আছে। কনসার্ট ছাড়াও ব্র্যান্ডিং এবং বাংলাদেশকে তুলে ধরার বিষয় আছে। এ ছাড়া নিউ ইয়র্ক ও সিলিকন ভ্যালিতে বিজনেস সামিট হবে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সাউথ এশিয়ান আইসিটি সেন্টার স্থাপনের জন্য সমঝোতা স্মারক অনুষ্ঠান এবং বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।

তবে প্রতিমন্ত্রী পলক বলেন, কনসার্টের জন্য একাধিক মন্ত্রী, এমপি এবং বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এসেছেন, তবে সে সংখ্যা কোনোভাবে ২০ জনের বেশি হবে না। আরও কয়েকজন এসেছেন নিজ খরচে। এ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অবকাশ নেই।

কনসার্টের স্থানীয় ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা ‘মেইন স্ট্রিম মিডিয়ার’ কর্ণধার ফরহাদের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দেননি।

এ কনসার্টের মোট ব্যয় ও বাজেট কত, বলতে রাজি হননি হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের এমডি বিকর্ণ কুমার ঘোষ। তিনি বলেন, এ আয়োজনে সরকার দিয়েছে ১০ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ এই কনসার্টে সহায়তা (স্পনসর) করছে। কোন প্রতিষ্ঠান কত টাকা দিচ্ছে, সেটা জানা হয়নি।

বিকর্ণ কুমার ঘোষ বলেন, কনসার্টে গাইবে বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড স্করপিয়ন্স ও বাংলাদেশের চিরকুট।

আইসিটি বিভাগ বলছে, কনসার্ট থেকে আসা অর্থ ইউএনডিপির মাধ্যমে স্বল্পোন্নত ও দরিদ্র দেশের শিশুদের সাইবার নিরাপত্তা সহায়তায় ব্যয় হবে।

জিও অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তাদের বেশির ভাগের যাত্রা মে মাসের শুরুতে এবং ১০-১৭ মের মধ্যে দেশে ফেরার কথা রয়েছে। ভ্রমণের পুরো সময় সরকারি দায়িত্ব পালন হিসেবে গণ্য হবে। আইসিটি বিভাগ ও এর অধীন ছয়টি প্রকল্প, আইসিটি অধিদপ্তর, হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের মোট ৩১ জন কনসার্টে যোগ দেওয়ার কথা। এই তালিকায় উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন— আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ, তার একান্ত সচিব সাইফুল ইসলাম এবং প্রতিমন্ত্রীর দুজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা রাকিবুল ইসলাম ও একরামুল হক, আইসিটি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. খায়রুল আমিন ও খন্দকার আজিজুল ইসলাম, শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন প্রকল্প পরিচালক মোস্তফা কামাল, হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকর্ণ কুমার ঘোষ এবং তার মেয়ে ও প্রকল্প সহায়ক গীতাঞ্জলী ঘোষ। আরও যাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, তার একান্ত সচিব মোহাম্মদ সানোয়ার হোসেন; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ কে এম রহমতুল্লাহ, তার একান্ত সচিব মো. মনিরুজ্জামান, কমিটির সদস্য নুরুল আমিন ও অপরাজিতা হক; সংরক্ষিত আসনের সাংসদ নাহিদ ইজাহার খান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমম্বয়ক জুয়েনা আজিজ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজমা মোবারক, পরিকল্পনা কমিশনের সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী জাহাঙ্গীর আলম।

অনুষ্ঠানে আরও যোগ দেবেন, জুনাইদ আহমেদ পলেকের মা জামিলা আহমেদ ও বোন ফারজানা আহমেদ, সংসদ সদস্য নুরুল আমিনের স্ত্রী রোকশানা পারভীন, সংসদ সদস্য অপরাজিতা হকের স্বামী মোজাম্মেল হক, এ কে এম রহমতুল্লাহর স্ত্রী হালিমা রহমতুল্লাহ, হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের স্ত্রী তাপসী ঘোষ, আইসিটি বিভাগের উপসচিব রেজা মো. আবদুল হাইয়ের স্ত্রী নিলুফার ইয়াসমিন, জেলা পর্যায়ে আইটি/হাইটেক পার্ক স্থাপন (১২টি জেলায়) প্রকল্পের পরিচালক এ কে এম ফজলুল হকের স্ত্রী ফারহানা আরাবিয়া, আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিবের স্ত্রী লাকি আক্তার ও তিন মেয়ে। অবশ্য এরা সবাই ব্যক্তিগত খরচে যোগ দেবেন বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ম্যাডিসন স্কয়ার বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেই স্থানে ৫০ বছর পর কনসার্টের উদ্যোগটি ভালো। কিন্তু যেসব সরকারি কর্মকর্তা যাচ্ছেন, তারা কোন মাপকাঠিতে যাচ্ছেন, আয়োজনের সঙ্গে তাদের কী সম্পৃক্ততা এবং কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা সরকারি আদেশে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। তার মতে, যারা যাচ্ছেন, সেখানে কার কী দায়িত্ব, সেটির জবাবদিহিতা প্রয়োজন। সরকারি টাকায় এ ব্যয়বহুল ভ্রমণের পেছনে যৌক্তিকতা না থাকলে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।

কনসার্ট আয়োজনের ভুল ত্রুটি নিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন প্রতিমন্ত্রী পলক। তিনি বলেন, গোল্ডেন জুবিলি বাংলাদেশ কনসার্ট-এর বিশাল এ আয়োজনে নানা ভুলক্রুটি ইতোমধ্যে চোখে পড়েছে এবং আগামীতেও ভুল হতে পারে; এজন্য আমি দূঃখ প্রকাশ করছি।

সম্পর্কিত পোস্ট