গ্রাহকদের প্রায় ৩২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে লাপাত্তা হওয়া ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘আকাশ নীল’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান ও পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান রনিকে ফরিদপুর ও রাজধানী ঢাকা থেকে গ্রেপ্তারের করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। সোমবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গত ১৮ মার্চ এক ভুক্তভোগী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘আকাশ নীল’ এর এমডি ও ডিরেক্টরসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন । আরও কয়েকজন ভুক্তভোগীও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়।
এরই ধারাবাহিকতায় রোববার রাতে র্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র্যাব-২ ও র্যাব-৮ এর যৌথ অভিযানে ফরিদপুর থেকে আকাশ নীলের এমডি মশিউর রহমান ওরফে সাদ্দাম (২৮) এবং পরিচালক ইফতেখাইরুজ্জামান রনিকে (৩২) রাজধানী ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযানে উদ্ধার করা হয় দুটি মোবাইল ফোন, দুটি ল্যাপটপ ও একটি প্রাইভেটকার।
জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কমান্ডার মঈন বলেন, আকাশ নীলের প্রতারণার মূলহোতা গ্রেপ্তার মশিউর। তিনি ব্যবসায়িক অবকাঠামো সম্পর্কে জানান, প্রথমে তার মাথায় ই-কমার্স ব্যবসার আইডিয়া আসে। তিনি অ্যামাজন, আলিবাবার মতো ব্যবসা করতে চান। এরপর ২০১৯ সালে আকাশ নীল কোম্পানি নামে ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ তৈরি করেন এবং ট্রেড লাইসেন্স নেন। প্রথমে তারা রাজধানীর কাঁঠালবাগান এলাকায় একটি অফিস নিয়ে নিত্যপণ্য এবং কৃষকদের কাছ থেকে শাকসবজি কিনে অনলাইনে হোম ডেলিভারি দেওয়ার ব্যবসা শুরু করে। তবে করোনা মহামারির কারণে ব্যবসায় ক্ষতি হয়।
পরে মশিউর আকাশ নীলকে লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করে কাঁঠালবাগান থেকে পান্থপথে অফিস স্থানান্তর করেন। কোম্পানিটি ছিল পরিবারকেন্দ্রিক ব্যবসা, যাতে তার নিজের নামে ৭৭ শতাংশ, বোনের নামে ১০ শতাংশ, মায়ের নামে ৮ শতাংশ ও তার স্ত্রীর নামে ৫ শতাংশ শেয়ার রাখেন। কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টরের চেয়ারে বসেন নিজেই। মাকে চেয়ারম্যান এবং তার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত বন্ধু ইফতেখাইরুজ্জামান রনিকে বসান পরিচালকের আসনে।
ইভ্যালিসহ অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের অফারে মোটরসাইকেলের রমরমা ব্যবসায় অনুপ্রাণিত হয়ে ২০২১ সালের জুন মাসে অফারে মোটরসাইকেল বিক্রির মাধ্যমে পুনরায় ব্যবসা শুরু করেন মশিউর। প্রথম ক্যাম্পেইনে ৩০ শতাংশ ছাড়ে দুই মাসের মধ্যে ডেলিভারির আশ্বাসে দুই শতাধিক মোটরসাইকেলের অর্ডার পান।
দ্বিতীয় ক্যাম্পেইনে ২৫ শতাংশ ডিসকাউন্টে ৪৫ দিনের মধ্যে ডেলিভারির নিশ্চয়তায় এক হাজারের বেশি মোটরসাইকেলের অর্ডার পান। সর্বশেষ গত বছরের আগস্ট মাসে মোটরসাইকেলের তৃতীয় ক্যাম্পেইনে ২৩ শতাংশ ছাড়ে ২৫ দিনের মধ্যে ডেলিভারির আশ্বাসে ৯ হাজারের বেশি মোটরসাইকেলের অর্ডার পান। পাশাপাশি মশিউর তার কোম্পানি থেকে লোভনীয় ছাড়ে দেন মোবাইল, ইলেকট্রনিক্স ও গৃহস্থালির অন্যান্য পণ্যের অফার। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইভ্যালিসহ অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযানের ফলে গ্রাহকরা পণ্য অথবা টাকা রিফান্ডের জন্য চাপ দেওয়া শুরু করেন। গ্রাহকদের চাপে গত নভেম্বরে মশিউর অফিস বন্ধ করে দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান।
কমান্ডার মঈন বলেন, তাদের অফার ব্যবসায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার গ্রাহক ছিল। তবে শেষ ক্যাম্পেইনে ছাত্র বা যুব সমাজের গ্রাহকরাই মোটরসাইকেলের অফারটি নেন। গ্রাহকদের টাকা সরাসরি মশিউরের নিজের ব্যাংক একাউন্টে জমা হতো। অন্যান্য ই-কমার্স ব্যবসার মতো গেটওয়ে সিস্টেম থাকলেও সরাসরি গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হতো। সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেওয়া অর্থ নিয়েই তারা প্রতারণা করতেন।
গ্রেপ্তার মশিউর ও রনিকে জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, আকাশ নীল লিমিটেড কোম্পানিতে প্রায় ৪০ জন অস্থায়ী কর্মচারী ছিল। যাদের মাসিক চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা বেতন দেওয়া হতো। গ্রাহকের টাকায় ধানমন্ডিতে তিন কোটি টাকায় একটি ফ্ল্যাট কেনেন মশিউর। তার রয়েছে দুটি ভিন্ন মডেলের দুটি দামি গাড়ি। এছাড়া তার কোম্পানির চারটি টাটা পিকআপ রয়েছে।