যেখানে মহাসড়কে ১২০ থেকে ১৪০ কিলোমিটার বেগে যানবাহন চলাচল করে, সেখানে সবাই জানে সাইকেলিং করা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। অথচ এই ঝুঁকি মাথায় নিয়ে মরুর দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে সাইকেল ভ্রমণে নামলেন বাংলাদেশি তরুণ মোহাম্মদ মোস্তফা। একুশ বছর বয়সী এই তরুণের দাবি, মাত্র ১২ দিনেই সাইকেল দিয়ে দেশটির বিভিন্ন প্রদেশ ঘুরেছেন তিনি। সাইকেলে দুই দেশের পতাকায় লাগিয়ে এই সময়ে আমিরাতের প্রাদেশিক শহর শারজা, দুবাই, আবুধাবি, ফুজাইরাহ, আজমান, উম্ম আল কোয়েন ও রাস আল খাইমাহ’র প্রায় এক হাজার ৬৮ কিলোমিটার সড়ক পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। এই প্রতিবেদকের মুখোমুখি হয়ে সিলেট ছাতক উপজেলার এই তরুণ জানান নিজের অভিজ্ঞতার কথা। সাইকেল চালিয়ে এবার হজে যাবার প্রত্যয় করেছেন মোস্তফা।
মোহাম্মদ মোস্তফা জানান, শখের বশে সাইকেলিং-এ স্বপ্নযাত্রা তার। ছোটবেলায় বাবার কিনে দেওয়া সাইকেল তাকে অনুপ্রাণিত করে। পড়াশোনার পাশাপাশি ধীরে ধীরে সাইকেলিংয়ে মগ্ন হয়ে ওঠেন। আগে যৎসামান্য ঘোরাঘুরি হলেও গত ফেব্রুয়ারিতে আমিরাতের ব্যস্ততম সড়কে এক হাজার ৬৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছেন। মাত্র ১২ দিনে ঘুরেছেন আমিরাতের সাতটি প্রদেশের শতাধিক জায়গায়। কখনো তীব্র গরমে চাকা ফেটে গেছে, কখনো ছিঁড়েছে চেইন, তবুও যাত্রা থামেনি। মাঝপথে এমন অঘটন ঘটলে মা ও ভাইদের সহেযাগিতা নিয়েছেন এই তরুণ। লক্ষ্যে পৌঁছার অদম্য ইচ্ছায় কেবল দুই চাকায় ভর করে সামনে এগিয়ে গেছেন। তবে নিরাপত্তা ও বিধিনিষেধের কারণে প্রবেশের অনুমতি পাননি কিছু কিছু জায়গায়।
মোস্তফা বলেন, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি বিকাল পাঁচটায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ ইসলামিক মিউজিয়াম থেকে যাত্রা শুরু করি। একই দিন মাজাজ, মামজার ঘুরে দেরা দুবাইয়ে প্রথম দিনের যাত্রা বিরতি করি। পরদিন বার দুবাই হয়ে বুর্জ আল আরব, পাম জুমেরাহ ও দুবাই মেরিনা হয়ে জাবেল আলীতে যাত্রা বিরতি করি। সেখানে যাওয়ার পথে তীব্র গরমে সাইকেলের একটি চাকা ফেটে যায়। এই অবস্থায় মায়ের কাছে ফোন দিলে তিনি নিজে নতুন চাকা পৌঁছে দেন। সাইকেল মেরামত করে আবার যাত্রা শুরু করি। ২০ ফেব্রুয়ারি দুবাই থেকে আবুধাবির উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। গান্তুত সীমান্তে পৌঁছলে সেখানকার নিরাপত্তাজনিত বিধিনিষেধের কারণে সীমান্ত অতিক্রম করতে পারিনি। পরে আবার আবুধাবির বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মাফরাক হাসপাতালে যাত্রা বিরতি করি। সেখান থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি আবুধাবির লিওয়া হয়ে আল খিসে যাত্রা বিরতি করি। এরপর আবুধাবি থেকে আল আইন, আল আইন থেকে ফুজাইরাহ, ফুজাইরাহ থেকে রাস আল খাইমাহ যেতে লেগে যায় ৪ দিন। সেখান থেকে একদিনে আমিরাতের আরও দুটি প্রদেশিক শহর উম্ম আল কোয়েন ও আজমান ভ্রমণ করি। এরপর যথারীতি শারজায় এসে যাত্রা বিরতি করি।
তিনি আরো বলেন, চলার পথে কয়েকবার পুলিশের বাঁধার সম্মুখীন হয়েছি। তবে তারা সাইকেল ভ্রমণের ব্যাপারে জানার পর সম্মান জানিয়ে এগিয়ে যেতে বলেছেন। আগামীতে এভাবে সাইকেল চালিয়ে সৌদি আরব যাবার স্বপ্ন দেখছি। সাইকেলে হজ যাত্রার সময় গুনছি।
মোস্তফার মা রুশানা বেগম জানান, মোস্তফার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সংযুক্ত আরব আমিরাতে। বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ অধ্যয়ন করছেন। পাশাপাশি ‘পার্ট টাইম’ হিসেবে চাকরি করেন। তার বাবা আনোয়ার হোসেন কর্মস্থলের সুবাদে ত্রিশ বছর পূর্বে দেশটিতে পরিবার নিয়ে আসেন। এখানে জন্ম হয় মোস্তফা সহ তার আরো দুই ভাইয়ের। খুব ছোটবেলায় শখ করে ছেলের হাতে সাইকেল তুলে দেন আনোয়ার হোসেন। সেই সাইকেল মোস্তফাকে ছুটে চলতে অনুপ্রেরণা জোগায়। কয়েকবছর পূর্বে বাবাকে হারালেও সাইকেলকে করেছেন সঙ্গী, চলেছেন অজানা বহুপথ।
রুশানা বেগম বলেন, তার (মোস্তফা) সাইকেলিং করতে দেখে আমরা ভয় পেয়েছিলাম। বিভিন্ন জায়গায় বাঁধার সম্মুখীন হয়েছে। কষ্ট করেছে। কখনো কুয়াশায়, কখনো বালিতেও তাকে সাইকেল চালাতে হয়েছে। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করতে পারেনি তখন। তবুও সে যে লক্ষ্যে পৌঁছেছে, এটাই সফলতা। এখন স্বপ্ন দেখছে সে সাইকেলে বিশ্বজয় করবে। এজন্য সবার সহযোগিতা কামনা করছি।
মোস্তফার সাইকেলিংয়ের বিষয়টি দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. আবু জাফরকে অবগত করা হয়।
রাষ্ট্রদূত মো. আবু জাফর বলেন, সারাপৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে সাইকেলিংয়ের জন্য আলাদা রাস্তা থাকে। যেমন অষ্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে দেখেছি সাইকেলিংয়ের জন্য আলাদা রোড আছে। সেখানে পর্যটকরা যান, সেসব রুটে সাইকেলিং করেন। দুবাইতেও সাইকেলের জন্য আলাদা রোড আছে। কিন্তু মহাসড়কে সাইকেল চালানো কোনো দেশেই অনুমোদন দেয় না। তাছাড়া মহাসড়কে সাইকেলিং করলে জরিমানা হবে।
রাষ্ট্রদূত আরো বলেন, তার (মোস্তফা) ভ্রমণের উদ্দেশ্য জানতে হবে। অনেকে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় বার্তা দিতে সাইকেলিং করেন। আবার সে যদি বাংলাদেশকে পরিচিত করতে সাইকেলিং করে, সেটিও হতে পারে। কিন্তু প্রত্যেকটি আমিরাতে প্রচুর বাংলাদেশি আছেন। এখানে প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি বসবাস।