(পূর্বে প্রকাশের পর) এরই মধ্যে এহতেশাম ২০০৭ সালে বাংলাদেশ থেকে ভাবীকে দুবাইতে নিয়ে আসলেন। ছিলেনও তিনমাসের মত। সময়ের সংলাপ, বাঁধন থিয়েটারের পাশাপাশি চাকরি। সবমিলিয়ে এহতেশাম একটি ব্যস্ত মানুষ। এতকিছুর পরও ভাবীকে ছায়ার মত পাশে রাখতেন। ভাবীর নাম ছিল মরিয়ম। এহতেশামের নাটক, বিনোদন, ব্যস্ততা ভাবী সবসময় উপভোগ হাসিমুখে করতেন। নিরহংকার এবং নির্মল প্রকৃতির মেয়েটিও যেন সকলের কাছে অল্পসময়ে আপন হয়ে উঠলেন। ভাবী রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হলেও এহতেশামের সকল কিছু যেন তার কাছে ছিল সুখের ঐশ্বর্য্য।
এহতেশাম যেই অফিসটিতে চাকরি করতেন তার নাম ছিল সাঈদ বিল গেজি কন্ট্রাক্টিং। এই অফিসের মূল অ্যাকাউন্টেন ছিলেন এহতেশাম। কোম্পানির মালিক (লোকাল আরবি) খুব ভালো করে জানতেন এহতেশামের সাংস্কৃতিক দুর্বলতা আছে। সেজন্য বৃহস্পতিবার আসলেই মালিক এহতেশামকে ফোন করে বলতেন- ‘তুমি অফিস নিয়ে অস্থির হয়োনা। আমি জানি, তোমার আজ নাট্যচর্চার দিন, তুমি সেখানেই চলে যাও। তোমার কমিউনিটি নিয়ে তুমি আনন্দ করো।’ কতবার এহতেশামের কাছে সেই অফিসে গিয়েছিলাম। আরবি দেখে আমাদের বলতেন, ‘তোমরা নিশ্চয়ই এহতেশামের নাটকের আর্টিস্ট’। আরবির কথা শুনে মনে মনে হাসতাম।
২০১১ সালে ভাবী (এহতেশামের স্ত্রী) আবার আসলেন। দেশ থেকে সঙ্গে করে অনেক ধরনের খাবার এনেছেন। এহতেশাম সকলকে দাওয়াত দিয়ে এসব খাওয়ালেন। ভাবীর সাথে আসলেন তাদের দুই কন্যা, মারুফা হক ও সাবিহা হক। মারুফার বয়স তখন ২ বছর, সাবিহার বয়স ১ বছর। সেই বার ভাবী ও দুই কন্যাকে নিয়ে আমিরাতের অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়ালেন এহতেশাম। একটি সুখী পরিবারের আবহ ফুটে উঠলো এই পরিবারের মাঝে।
কিন্তু কে জানতো, তাদের এই সুখের যাত্রা থমকে দাঁড়াবে! হঠাৎ একদিন এহতেশাম এসে বললো- ‘একটি বাংলাদেশি কোম্পানী থেকে বড় চাকরির অফার পেয়েছি। সেলারিও অনেক বেশি।’ আমি এহতেশামকে বারণ করলাম। সে শুনলো না। হঠাৎ বিল গেজি কন্ট্রাক্টিংয়ের হিসাব রক্ষকের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশি ট্রান্সফর্ম ফ্যাশন এলএলসি নামক একটি কোম্পানিতে সিনিয়র সেলসম্যান হিসেবে যোগ দিলেন। কিন্তু এই কোম্পানিতে এসে এহতেশাম নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারলেন না। কাজের প্রেসার অনভিজ্ঞতার কারণে এহতেশাম দিনদিন অস্থির হয়ে উঠছিলেন। হঠাৎ করে নাটক, বিনোদন, সময়ের সংলাপ থেকে অনেকটা ছিটকে পড়লেন। এক পরিপূর্ণ যুবক যেন মানসিক অস্থিরতায় শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লেন। তখনও এহতেশামকে অনুরোধ করলাম, এই চাকরি ছেড়ে দিতে। কিন্তু তার কথায় ফুটে উঠলো, চাকুরি ছাড়ার কোনো উপায় নেই।
২০১১ সালের অক্টোবর মাসে মাঝামাঝিতে সন্ধ্যার সময় শারজার ন্যাশনাল পেইন্ট এলাকায় তার নিজ বাসভবনে হঠাৎ ব্রেন স্ট্রোক করেন এহতেশাম। পার্শ্ববর্তী বাসার এক ভারতীয় প্রতিবেশীর সহযোগিতায় এহতেশামের স্ত্রী ভাবী মরিয়ম এহতেশামকে মুমূর্ষ অবস্থায় কুয়েতি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করান। কুয়েতি হাসপাতালে সেই সময়কার নামকরা বাঙালি ডাক্তার আতিউর রহমানের তত্ত্বাবধানে এহতেশাম ১৭ দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে জীবন ফিরে পান। কিন্তু আজীবনের জন্য এহতেশাম একটি হাত ও একটি পায়ের স্পন্দন শক্তি হারিয়ে ফেলেন।
এমন অবস্থায় এহতেশামের স্ত্রী তাকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য নির্ঘুম অবিরাম যুদ্ধ শুরু করলেন। সেসময় অশ্রুসজল ভাবীর নির্মল বাকরুদ্ধ চেহারা দেখে এমন কোনো মানুষ নেই যে অশ্রু সংবরণ করতে পেরেছেন। সবচেয়ে বেশি কষ্ট লেগেছিল তার ছোট ছোট দুটি কন্যা সন্তানের জন্য। সবাই একবাক্যে বলেছিল- ‘কি হবে দুটি কন্যার ভবিষ্যৎ?’ প্রায় ১৪ দিন পর এহতেশামের জ্ঞান ফিরে। ডাক্তারের পরামর্শক্রমে এহতেশামকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। সাথে তার-স্ত্রী ও কন্যা সন্তানরা চলে আসেন বাংলাদেশে।
সেসময় এহতেশাম যেই কোম্পানিতে চাকরি করতেন সেই কোম্পানি তাকে কত টাকা পয়সা দিয়েছেন তা জানার সুযোগ হয়নি। এরপর দেশে একদিন এহতেশামকে দেখতে চট্টগ্রাম মোহরাস্থ তার বাড়িতে যাই। তাকে যে অবস্থা দেখেছি, সেই অবস্থায় দেখে আমার ভেতরটা যেন চুরমার হয়ে যাচ্ছিল। হায়রে মানুষের নিয়তি! কি টগবগে যুবক, শুদ্ধ উচ্চারণের মাধ্যমে তুমুলভাবে নাটকের ডায়লগ বলতো! সেই যুবকটি আজ প্রাণের আকুতি দিয়ে কি বোঝাতে চাচ্ছে, তা আমি ঠিক মত বুঝতেও পারছিলাম না। সে আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। বুঝাতে চাইলো, তার আত্মিক কষ্টের কথা। সে সাথে চাইলো একটি চাকরি। আমি দেখতে পেলাম, কতটা নাজুক অবস্থা হলে শারীরিক এই অক্ষমতা অবস্থায় একটি মানুষ চাকরির সন্ধান করেন। কিন্তু আমার দ্বারা সম্ভব হয়নি তাকে চাকরির সন্ধান করে দেয়া। আমি বন্ধু-বান্ধব এবং সময়ের সংলাপ ও বাঁধন থিয়েটারের পরিচিতজনদের বিষয়টি জানালাম। পরবর্তীতে কে কতটুকু করেছে তা আমার আর জানা নেই। আমিরাতের মাটিতে যখনই এহতেশামের কথা মনে পড়ে অথবা তার স্মৃতিচিহ্ন চোখের পলকে ভেসে উঠে তখনই তার জন্য হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতো।
২০১১ সাল থেকে ২০২১ সাল। দীর্ঘ দশটি বছর অতিবাহিত হয়েছে। ভাবী মরিয়ম (এহতেশামের স্ত্রী) জীবনের সবকিছু উজাড় করে দিয়ে নিজের স্বামীর সেবা করেছেন। এহতেশামের সমস্ত নাজুকতা হাসিমুখে বরণ করেছেন। তিলে তিলে চেষ্টা করেছেন, চেয়েছেন এহতেশাম যেন আগের অবস্থায় ফিরে আসুক। হয়ত দু ফোঁটা অশ্রুজল ফেলে স্বপ্ন বুনতেন তাদের সুখের সোনালী দিনগুলো ফিরে পাওয়া নিয়ে। ভাবীকে প্রশ্ন করেছিলাম- ‘ভাবী কেমন আছেন?’ উত্তরে বলেছিলেন- ‘এহতেশাম যে বেঁচে আছে এটা আমার অনেক বড় পাওয়া। দোয়া করবেন সে যেন অনেক দিন বেঁচে থাকে।’ এত কষ্ট কেমন করে একটি মানুষ সহজভাবে মেনে নিতে পারেন তা এহতেশামের স্ত্রীকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। স্বামীর প্রতি যে তার পরম দায়িত্ববোধ, ভালোবাসার অটুট বন্ধন, এই নারী অক্ষরে অক্ষরে তা প্রমাণ করেছেন।
প্রায় ৬/৭ বছর এহতেশাম ঘরে বসে থাকার পর চেষ্টা করেছেন নাজুক শরীর নিয়ে কর্মমুখী হতে। চট্টগ্রাম অ্যাপোলো শপিং সেন্টারে একটি পুতুলের দোকানে চাকরি নিয়েছিলেন এহতেশাম। নাজুক শরীর নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন নিজেকে একজন সক্ষম পুরুষ হিসেবে দাঁড় করতে। বর্তমানে চট্টগ্রাম সিঙ্গাপুর- ব্যাংকক শপিং সেন্টারে লিবার্টি বাজারে ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এহতেশাম।
গত কয়েকদিন আগে আমি দেশে এসেছি জানতে পেরে ফোন দিয়ে দেখা করতে বললেন। আমিও দেখা করতে গেলাম। সিঙ্গাপুর ব্যাংকক মার্কেটের তৃতীয় তলায় দেখা হওয়ার পর আলিঙ্গন শেষে কুশল জানতে চাইলাম। কিন্তু মলিন মুখে এহতেশাম আমাকে যে সংবাদটি দিলেন তা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। যেই মানুষটির ভরসায় এহতেশাম বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতেন। যার নিবিড় পরিচর্যায় এহতেশাম মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন। যার হাত ধরে এহতেশাম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পুনরায় হাঁটার অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন। সেই মানুষটি এহতেশামকে ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছেন। ভাবীর এই মৃত্যুর কারণ মহামারি করোনা। চলতি বছরের ১৫ আগস্ট চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালে ১২দিন আইসিইউতে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে হেরে গেলেন মরিয়ম ভাবী। এই মৃত্যু মেনে নেওয়ার মত নয়। আর এহতেশামতো কোনোভাবেই তা মানতে পারছেনা।
এই করোনা মহামারি যে কত তাজা প্রাণ, প্রিয়জন, প্রিয়তমা, নির্ভরতা, অবলম্বন, স্বপ্ন-সাধনা কেড়ে নিয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কিন্তু এই কেমন নিষ্ঠুরতা। একজন পঙ্গু ও ক্ষত-বিক্ষত মানুষকেও নিসঙ্গ করে দেয়!
এহতেশাম জানালো, করোনা হয়েছিল দেখে এহতেশামকে নিরাপদ রাখার জন্য ভাবী তাকে ভালোবাসার কসম দিয়েছিলেন যেন তাকে দেখতে না যায়! সেই কথা রক্ষার জন্য এহতেশাম ভাবীকে দেখতে আর হাসপাতালে যায়নি। বিদায়কালে তারা দু’জনের মাঝে আর কোনো কথা হয়নি। এই বিষয়টি এহতেশামকে ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে।
এহতেশামকে যখন বললাম- ‘আমি আপনাকে নিয়ে লিখতে চাই।’ তখন অশ্রু সজল নয়নে এহতেশাম জানালো, আপনার ভাবীর বিষয়টি একটু তুলে ধরবেন। বললেন, জানেন সে আমাকে কত ভালবাসত ? আমি আজ প্রচন্ড একা! জানিনা, আমি আর কতদিন বাঁচবো। আমার মেয়েগুলোর জন্য দোয়া করবেন। এদের অভিভাবক আপনারাই।’
এহতেশামের বড মেয়ে মাফরুহা হক এখন চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ সিডিএ স্কুল অ্যান্ড কলেজে ক্লাস নাইন ও সাবিহা হক ধানসিঁড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজে ক্লাস সেভেনে পড়ছে।
জীবনের সাথে অবিরাম যুদ্ধ করে যাওয়া এহতেশামের অবলম্বন এখন কেবলই তার দুটি মেয়ে। সকলে তার জন্য দোয়া করবেন। এই দুটি মেয়ে বড় হয়ে যেন তার সকল দুঃখ মুছে দিতে পারে।