প্রচন্ড গরমে সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতারি কিনতে বাজারে যান ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা চালক জয়নাল আবেদীন (৫০)। জানতে চান এককেজি শসার দাম। ৮০ টাকা দাম শুনে ফ্যালফ্যাল করে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকেন শসার দিকে। তারপর হাঁটা ধরেন জয়নাল। এত দামে সামান্য সালাদের শসা কেনা তার সাধ্যের বাইরে।
রমজানের ১ম দিনে এমনটিই চোখে পড়ে মিরসরাই উপজেলার আবুতোরাব বাজারে। শুধু এক জয়নাল না, এমন হাজারো জয়নাল অসহায় নিত্যপণ্যের লাগামহীন দামের কাছে।
রমজানের ২য় দিন সকালে ছিন্নবস্ত্রপরিহিত দিনমজুর শ্রেণীর আলাউদ্দিন (৪০) নামের আরেক লোককে বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ ঘুরঘুর করতে দেখা যায় বড়তাকিয়া মাছ বাজারে। দীর্ঘসময় ধরে মাছের দরদাম করে শেষমেশ কিনতে পারেননি মাছ। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি তার জীবনে কি প্রভাব ফেলেছে জানতে চাইলে ছলছল করে উঠে তার চোখ। চোখের জল আড়াল করে বলেন, সবকিছুর দাম বেশি, শুধু আমাদের খাটুনিটাই সস্তা। সারাদিন রাজমিস্ত্রির কামলা দিয়ে ৪০০ টাকা বেতন পাই। কিন্তু সবসময় কাজ থাকেনা। কষ্টে শিষ্টে চলে দিন। চাইলেই মাছ-মুরগি কিনতে পারিনা। কিন্তু রমজান মাসে পোলাপাইনরা একটু ভালো খাইতে চায়। আমারও পোলাপাইনদের সবসময় শাকসবজি খাওয়াতে খারাপ লাগে। তবু নিরুপায় আমি। বাজারের সব পণ্যেরই দাম বেশি। এভাবে চলতে থাকলে আমরা গরিবরা মরে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবেনা।
রমজানকে কেন্দ্র করে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কাঁচাবাজার, মাছ-মুরগি ও মাংসসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম। তবে তুলনামূলক ভাবে বেশি বাড়ছে ইফতার সামগ্রির কাাঁচামালের দাম। ইফতারের অন্যতম আইটেম শরবৎ তৈরীতে লেবুর বিকল্প নেই। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে বাড়িয়ে দিয়েছেন লেবুর দাম। উপজেলার প্রায় সবকটি বাজারে হালিপ্রতি লেবু বিক্রি হচ্ছে ৪০-৬০ টাকা দরে। বেড়েছে বেগুনি তৈরীর প্রধান কাঁচামাল বেগুনের দামও। জাতবেদে বেগুন বিক্রি হচ্ছে ১০০-১৫০টাকা পর্যন্ত।
রমজানে কেন এ বাড়তি দাম জানতে চাইলে কাঁচাবাজার ব্যবসায়ী রাসেল বলেন, রমজানে মানুষের চাহিদা বেশি। আমরা সকালে পণ্য যা আনি তার ভেতর বিশেষ করে লেবু, শসা, বেগুন এসবের প্রচুর কাটতি। বিকেল হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায় এ কয়টি আইটেম। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। আমরা বেশি দামে কিনছি। তাই বাড়তি দরেই বিক্রি করতে হচ্ছে।
এদিকে রমজানের আগে থেকে কলার দাম বাড়তি থাকলেও রোজা শুরুর পর বেড়ে হয় দ্বিগুণ। ২য় রমজানে উপজেলার কোর্ট রোডের আবু সাঈদ নামের এক দোকানদারকে ৩০ টাকা জোড়া দরে কলা বিক্রি করতে দেখা যায়। কলার মূল্য এতো বেশি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, কলার সাপ্লাই কম। বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। তাই বেশি দামেই বিক্রি করছি।
সারাদিন রোজা রাখার পর একচুমুক ডাবের পানি স্বস্তি এনে দিলেও দামে কোন স্বস্তি নেই। সাফয়েত মেহেদী নামের এক তরুণ জানান, মিরসরাই পৌর সদর থেকে তিনি অনেক দরদাম করে ১৮০ টাকায় কিনেন দুটি ডাব।
স্বস্তি নেই ফলফলাদির দামেও। গরমের মৌসমে তরমুজ একটি প্রিয় ফল হলেও নিম্নমধ্যবিত্তের সাধ্য নেই তরমুজ ছোঁয়ার। জাত ও আকারবেদে প্রতিটি তরমুজ বিক্রি হচ্ছে ২৫০-৫০০ টাকা পর্যন্ত। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মৌসুমি ফলের দামও। বরই প্রতি কেজি কিছুদিন আগে ৪০-৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। পেয়ারার দামও বেড়েছে প্রতি কেজিতে প্রায় ৪০ টাকা।
রমজানের ৩য় দিনে উপজেলার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সব বাজারে সবজির দাম কমবেশি একই। প্রতিটি সবজির দামই বেড়েছে। দুই দিন আগে যে বেগুন ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, সেই বেগুন এখন ৭০-৮০ টাকা। ৩০-৪০ টাকার ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়। গাজর বিক্রি হচ্ছে কেজি ৬০-৭০ টাকা, ঢেঁড়স ৫০-৬০, বরবটি ৫০-৬০, পটোল ৬০-৭০, চিচিঙ্গা বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকা, ঝিঙে ৪৫-৫৫, লাউ ৫০, মিষ্টি কুমড়া ৬০-১৫০ টাকা, করলা ৬০-৭০ টাকা, কচুর লতি ৮০-১০০ টাকা, কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে বাজারভেদে ১২০-১৫০ টাকায়।
এছাড়া আলু কেজিতে ২ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা দরে। দাম বাড়ার দিকে পিছিয়ে নেই মাছের বাজারও। যে কোনো ধরনের মাছ কেজিতে ১০-১৫ টাকা বেড়েছে। বড় আকারের কাতাল, রুই ২৮০ থেকে ৩৬০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ২৬০-৩০০ টাকায় পাওয়া গেছে। কোরাল ৪৫০-৬০০, কৈ ১৫০-১৮০, শিং ৩০০ -৪০০, তেলাপিয়া ১৬০-১৭০, চিংড়ি ৬০০-১০০০, পাবদা ৩০০ -৩৫০, পাঙাস ১৫০-১৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।