সাংবাদিকতা পেশা মানেই চ্যালেঞ্জ। দূর্বার সাহসিকতা, ঝুঁকি নেয়ার ক্ষমতা, কৌশলী, বুদ্ধি প্রয়োগ থেকে শুরু করে তথ্য সংগ্রহ পর্যন্ত একজন সংবাদকর্মীকে চরম ধৈর্যের পরিচয় দিতে হয়। এজন্য তাকে সময়কে সময় অপেক্ষা করতে হয়। তার সংবাদটিকে বস্তুনিষ্ঠ, বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে একজন মাঠ সাংবাদিকের গুরুত্ব অত্যাধিক।
কেননা একজন মাঠ সাংবাদিককে খবরের ভেতর থেকে ভেতরে যেতে হয়। এই খবরের সুরঙ্গে যেতে তাকে ধাপে ধাপে পা ফেলে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। এজন্য তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যায় উপনিত হতে পারে। হয়ও অনেকে। প্রকাশ্যে হোক আর গোপনেই হোক একজন মাঠ সাংবাদিকতায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক সময় নেমে আসতে পারে বিভীষিকার অন্ধকার।
তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষে অনলাইন সংবাদমাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে অনেকে মনে করতে পারেন, ঘটনাস্পটে যাওয়ার কী দরকার। ঘরে বসেই থেকে দ্রুতগতিতে তথ্য সংগ্রহ করা যায়। বিনা পরিশ্রমে অপরের কাছ থেকে নিউজটি কালেক্ট করে শুধু নিজের নাম বসিয়ে দিতে পারলেই বেশ। কিংবা অনলাইনে প্রকাশিত রিপোর্টটি কাট/কপি, পেষ্ট করে সামান্য রদবদল করে পাঠালেই তো হলো। কে দেখবে এটা অন্যের রিপোর্ট? ঘরে বসেই তো সহজ! অনলাইনের যুগে ঘটনাস্থল কিংবা মাঠে গিয়ে সময় কোথায়? দু’এক জায়গায় মোবাইলে ফোনে জেনে নিয়ে ই-মেইলে কিংবা ফেসবুক মেসেঞ্জার কিংবা হোয়াটঅ্যাপস-এ ধার করতে পারলেই হলো খবরটি। তো বসে থেকেই সংবাদও হয়ে গেল, পত্রিকাতেও প্রকাশিত হলো। হাতে টুপাই-ও আসলো। আসলেই কী কাট, কপি, পেষ্ট সাংবাদিকতার সৃষ্ট খবরটি বস্তুনিষ্ঠ, নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য হবে এমন নিশ্চিত হতে পারে?
অবশ্যই না। কারণ ঘরে বসে যে ঘটনার সংবাদটি আপনি তৈরি করছেন তাতে তথ্যগত ভুল থাকা অস্বাভাবিক নয়। এক ধরণের হলুদ সাংবাদিকতা রূপ নিতে পারে এ ধরণের কর্মকান্ডে। একাধিকবার কোন রিপোর্টে তথ্য বিভ্রাট হলে সে সংবাদ যেমন ভিত্তিহীন হয়ে উঠে, তেমনি সাংবাদিকতার ভিত্তিও দূর্বল থেকে দূর্বলে এসে পেশাগত সুনাম ক্ষয়ে যেতে পারে নিমিষেই। এতে করে বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা হারানোর যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। তবে হলুদ সাংবাদিকদের এই লাজবোধ টুকু নেই। তারা মূলত চামচামি, দালালি করতেই কার্ডধারী সাংবাদিক হয়ে থাকেন। কিন্তু একজন পেশাদার সাংবাদিক তার নিজস্ব আত্ম সম্মানবোধ, বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টির প্রতি অত্যাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
সংবাদমাধ্যমকে সমাজের দর্পন বলা হয়। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তম্ভ হচ্ছে গণমাধ্যম। সেই গণমাধ্যমের প্রতিটি সংবাদকর্মীকে দেশের সাধারণ মানুষ ও রাষ্ট্রের মেডিয়েটর বা মাধ্যম হয়ে কাজ করতে হয়। জন মানুষের প্রত্যাশা ও চাহিদা বহি:প্রকাশ তা নীতি নির্ধারকদের কাছে পৌছে একজন সাংবাদিকের মাধ্যমে। তাদের নিত্য নতুন ধারণা ও বিষয় মানুষের কাছে হাজির হওয়ার মধ্য দিয়ে একজন সাংবাদিককে সমাজের শিক্ষক ও গাইড হিসেবে কাজ করার গুরুত্ববহন করে।
যার কারণে একজন পেশাদার মাঠ সাংবাদিককে প্রতিটি খবরের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক সময় কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। সে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে কষ্টসাধ্য খবরটি প্রকাশের পর তার যেমন শ্রম সাধ্য হয়, তেমনি খবর প্রকাশের পর মুখোমুখি হতে পারে নতুন কোন কঠিন চ্যালেঞ্জের। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদটির ক্রিয়া/প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। মাঠ সাংবাদিকতাকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বলা হয়।
অনেকেই হয়তো থ্রিলার বই মাসুদ রানা পড়েছেন। একজন সাংবাদিককে অনেক সময় মাসুদ রানা হতে হয়। অনেক সময় ঘটনার অন্তরালে যেতে সিআইডি তথা গোয়েন্দাগিরিও করতে হয়। কারণ, লক্ষ্য তথ্য সংগ্রহ। বলা হয়, যে সাংবাদিকের হাতে যতো বেশি তথ্য, সে ততো বেশি ক্ষমতাধর। কারণ তার একেকটি তথ্য পারমানবিক বোমার মতো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। এই তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে পেশাদার সাংবাদিকদের বিভিন্ন সময় হামলা, মামলা, জেল, জুলুম, অপহরণ, নিপীড়ন এমনকি হত্যার শিকার হতে হয়। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ১৫৪ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হামলা-মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন।
বলা হয়, সাংবাদিকের একটা পা সব সময় জেলখানার জন্য নির্দিষ্ট থাকে। কখন তাকে কোন পরিস্থিতিতে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয় তা বলা মুশকিল।
কোন ঘটনায় ছবি/ভিডিও করতে গিয়ে মারধর, ক্যামেরা ছিনতাই, আটকে রেখে নির্যাতন, হামলা, মামলায় জেল হাজত এমনকি নির্বাসনে যেতে হতে হয়। সাংবাদিকের রিপোর্ট পক্ষে গেলে ভালো, আর বিপক্ষে গেলে তো রেহাই থাকে না। সাংঘাতিক’ অপ-সাংবাদিকতার তোকমা, সোস্যাল মিডিয়ায় ট্রলসের মাধ্যমে হুমকির শিকার, ডিজিটাল মামলা, আটক হয়রানিসহ নানান বিষয়ে একজন মাঠ সাংবাদিককে বারবার আঘাত প্রাপ্ত হয়ে দু:সহনীয় পরিস্থিতির ভিতর নিজের কর্মনিষ্ঠার উপর অটল রেখে একজন মাঠ সাংবাদিককে সমাজের যাবতীয় অপরাধসহ নানাবিধ লোমহর্ষক অপরাধের খবরাখবর প্রকাশ করতে হয় বুকে সাহস বেঁধেই। খবরের পেছনের খবর সংগ্রহ করতে তাকে মুখোমুখি হতে হয় কঠিন চ্যালেঞ্জের।
সম্প্রতি রাজধানীর নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ ঘটনার ছবি/ভিডিও ও তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মারধরের শিকার হতে হয়েছে। আমরা দেখেছি কক্সবাজারের মফস্বল সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খানের উপর এক পুলিশ কর্মকর্তার নির্মম নির্যাতন। তার অপরাধ ছিল মাদকের বিরুদ্ধে রিপোটিং করা হয়। এরকম ঘটনা অনেক।
একজন নতুন কিংবা শিক্ষানবীশ সংবাদকর্মীকে মাঠ সাংবাদিকতায় দক্ষ করে তুলতে পারে। এটা ঠিক এরকম যে এন্টারমাইনটেট হিসেবে কিছুদিন কাজ করে অভিজ্ঞতা তৈরি করা। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ কিংবা যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোন স্নাতকোত্তর নিয়ে অনেকেই হয়তো সংবাদমাধ্যমের প্রতিষ্ঠানে নিউজ ডেস্কে সাব-এডিটর, নিউজ এডিটর হিসেবে কর্মস্থলে যোগ দেন। একজন মফস্বল সাংবাদিকের মাঠ পর্যায়ে যে অভিজ্ঞতা তৈরি হয় তা হয়তো নিউজ ডেস্কে কাজ করা ব্যক্তির সে অভিজ্ঞতা হয় না। তাঁর কাজ শুধু মেইলে প্রাপ্ত সংবাদটি সম্পাদনা করা। ভুল হলে সংশোধন তথা প্রতিবেদনের গঠন ঠিক করা, উক্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার যোগ্য কীনা তা নিউজ এডিটর/সম্পাদককে দেখানো। একটি গন্ডির মধ্যে কাজ করতে হয়। কিন্তু স্টাফ রিপোর্টার কিংবা মফস্বল সাংবাদিকদের মাঠে সংবাদটির তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে যেসব ঘটনা, স্থান, তথ্য নিশ্চয়তার জন্য সোর্স, সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বক্তব্য সংগ্রহ করতে বিভিন্ন স্থান দৌঁড়ঝাপ করতে হয়। কারণ ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে কোনো একটি ঘটনা পৌঁছানোর আগে একবার তাদের হাতে এর ‘ফিল্টারিং’ হয়। সেজন্য সাধারণ মানুষ কী জানবে, কতটুকু জানবে বা কতটুকু দেখবে সেটি অনেকটা নির্ভর করে সাংবাদিকদের দক্ষতা, যোগ্যতা, পেশাদারিত্ব এবং নিরপেক্ষ মননের ওপর। একটি বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ, বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্য প্রতিবেদন তৈরি করতে হলে মাঠ সাংবাদিকতা ছাড়া সম্ভব নয়।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট ; তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড়।
( প্রিয় পাঠক, আপনিও মূল্যবান মতামত জানিয়ে লিখুন সময়ের সংলাপে। আপনার পাঠানো লেখা প্রকাশের উপযোগী হলে পাঠক মতামত-এ তা প্রকাশ করা হবে। news.somoyersonglap@gmail.com এই ঠিকানায় লেখা পাঠাতে হবে। – নির্বাহী সম্পাদক )