টিকে থাকার সব ধরনের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে মধ্যরাতে পতন হলো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের। কাজ হলো না ট্রাম্পকার্ডে। সংবিধান লঙ্ঘন করে ‘নো বলে উইকেট’ নেওয়ার মূল্য দিতেই হলো তাকে। দিনভর পার্লামেন্টে একের পর নাটকীয়তার অবসান হলো অনাস্থা ভোটে ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রিত্ব খোয়ানোর মধ্য দিয়ে। এখন আরও বিপদ তাড়া করবে তাকে। পড়তে হবে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার মুখে। খবর সমকালের।
পাকিস্তানের ইতিহাসে শনিবার এক অন্য ইতিহাসের জন্ম হলো। এই প্রথম দেশটির কোনো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খান অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হলেন। এর আগে ১৯৮৯ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো ও ২০০৬ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শওকত আজিজের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব তোলা হয়েছিল। তবে উভয়েই সেই ভোটে জিতে ক্ষমতায় টিকে গিয়েছিলেন।
অনাস্থা প্রস্তাব বাতিল ও পার্লামেন্ট বিলুপ্তির আদেশ অবৈধ ঘোষণা করে শুক্রবার ঐতিহাসিক রায় দেন পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট। সেই রায় অনুযায়ী শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় পার্লামেন্টের (জাতীয় পরিষদ) অধিবেশন শুরু করেন স্পিকার আসাদ কাইসার। শুরু হয় উত্তেজনা। প্রথম থেকে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনে বিরোধীদের প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত করেন স্পিকার। সরকারদলীয় আইনপ্রণেতাদের দীর্ঘ বক্তব্য শুনতে থাকেন। বিরোধীরা অনাস্থা প্রস্তাব তোলার ওপর জোর দিলেই চার দফায় অধিবেশন মুলতবি করেন। তবে শেষ রক্ষা করতে পারেননি স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার। ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’ তত্ত্বে অনড় থেকে ইমরান খানের প্রতি দ্ব্যর্থহীন আস্থা দেখিয়ে পদত্যাগ করে পার্লামেন্ট ছাড়েন তারা দু’জন।
স্পিকারের কাইসারের পদত্যাগের পর নতুন করে শুরু হয় পার্লামেন্টের কার্যক্রম। স্পিকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন সাবেক স্পিকার আয়াজ সাদিক। দেশটির পার্লামেন্টের আইন অনুযায়ী, স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার পদত্যাগ করলে পার্লামেন্টের ছয় সদস্যের একটি প্যানেলের চেয়ারম্যান অধিবেশন চালাতে পারেন। সে অনুযায়ী, অধিবেশন পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন আয়াজ সাদিক।
পদত্যাগের আগে স্পিকার কাইসার বলেন, ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ষড়যন্ত্রের পোক্ত নথি মন্ত্রিসভার মাধ্যমে তার হাতে এসেছে। এটি দেখার জন্য প্রেসিডেন্ট ও সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির প্রতি অনুরোধ করেন তিনি। এরপর দায়িত্ব নিয়ে আয়াজ সাদিক বলেন, দলের প্রতি আস্থাশীল থেকে মর্যাদার সঙ্গে দায়িত্ব হস্তান্তর করেছেন স্পিকার কাইসার।
অধিবেশন চালানোর দায়িত্ব পেয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপনমূলক বক্তব্য দেওয়ার পর পার্লামেন্টে পাঁচ মিনিটি ধরে বেল বাজিয়ে এমপিদের (জাতীয় পরিষদ সদস্য) সতর্ক করেন নবনিযুক্ত স্পিকার আয়াজ সাদিক। এরপর পার্লামেন্টের সব দরজা বন্ধ করে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এরপর আবার দরজা খুলে প্রস্তাবে পক্ষের এমপিদের বাইরে অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান। নিয়ম অনুযায়ী, চার মিনিটের জন্য পার্লামেন্ট মুলতবি করেন। এরপর আবার অধিবেশন শুরু করেন। নির্দিষ্ট রেজিস্ট্রারে ভোটাররা স্বাক্ষর করার পর সেটির নথি স্পিকারের কাছে পাঠানো হয়।
ভোট গণনা শেষে স্থানীয় রাত ১টায় ফল ঘোষণা করেন আয়াজ সাদিক। পার্লামেন্টের ৩৪২ আসনের মধ্যে অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়েছে ১৭৪টি। ইমরান খানকে পরাজিত করতে বিরোধীদের প্রয়োজন ছিল ১৭২ ভোটের। ভোটের পর পাকিস্তান মুসলিম লিগ-এনের মুখপাত্র মরিয়ম আওরঙ্গজেব জানান, স্পিকারের দায়িত্ব নেওয়ায় আয়াজ সাদিক ভোট দেওয়া বিরত থাকেন। এ ছাড়া ইমরান খানের দলের এমপিদের ভোট গণনায় নেওয়া হয়নি।
ক্ষমতা হারানোর বিষয়ে নিশ্চিত হয়েও ইমরান খান শেষবেলায় রাজনৈতিক নাটক জমিয়ে তোলেন। একদিকে যেমন তার ভক্ত স্পিকার অনাস্থা ভোট গ্রহণে গড়িমসি করতে থাকেন, অন্যদিকে নিজ দলের আইনজীবীদের দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতেই আপিল আবেদন জমা দেওয়ান। এরই মধ্যে পার্লামেন্টে চলতে থাকে সরকারি দল ও বিরোধী দলগুলোর সদস্যদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। অনাস্থা প্রস্তাব তুলতে বিলম্ব করায় ইমরান খানের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর সঙ্গে নতুন করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ করেন পার্লামেন্টের অন্যতন বিরোধী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুটো।
কিছু সময় পর জানা যায়, সেনাপ্রধান কামার বাজওয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ইমরান খান। বিষয়টি নতুন সংশয়ের জন্ম দেয়। তাহলে কি অন্য কোনো অঘটন ঘটতে চলেছে। তবে শেষ পর্যন্ত সেসব ভুল প্রমাণিত হয়। পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটেই নির্ধারিত হয় ইমরান খানের ভাগ্য।
ইমরান খানের আস্থাভাজন স্পিকার ৩ এপ্রিল অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ করার পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করেন। দেশটির সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক পদক্ষেপে পার্লামেন্ট সক্রিয় হওয়ার পর গতকাল প্রথম অধিবেশন বসে। সেখানে ইমরান খানের ভাগ্য নির্ধারণ হওয়ার কথা। তবে পার্লামেন্টে দিনের কার্যতালিকায় চার নম্বরে ছিল অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটির বিষয়টি।
অনাস্থা প্রস্তাবের ভোটে অংশ নিতে গতকাল পার্লামেন্টে (জাতীয় পরিষদ) বিরোধী সব আইনপ্রণেতা সকাল থেকে উপস্থিত ছিলেন। তবে পিটিআইর হাতেগোনা কয়েকজনকে দেখা যায়। ইমরান খানকেও পার্লামেন্টে দেখা যায়নি। তবে সরকারদলীয় যে ক’জন আইনপ্রণেতা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশি। তিনি পার্লামেন্টে বক্তব্য দেন। এ সময় ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে হটাতে ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’ তত্ত্ব ফের উত্থাপন করেন। দীর্ঘ বক্তব্য দিলেও তিনি কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেননি।
স্পিকারের সঙ্গে বৈঠকের পর বিরোধীদলীয় নেতার চেম্বারে একটি বৈঠক হয়। সেখানে বিরোধী দলগুলোর সব আইনপ্রণেতা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় পিএমএল-এনের নেতা খাজা সাদ রফিক জানান, স্পিকার কথা দিয়েছেন, ইফতারের পর তিনি অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করবেন।
পার্লামেন্ট অধিবেশন বসার আগে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ইমরান খান বলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় তিনি মেনে নিচ্ছেন। তবে ‘আমদানি করা সরকার’-এর বিরুদ্ধে তার লড়াই চলবে। এ সময় তিনি বিদেশি ষড়যন্ত্রে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়টি উল্লেখ করে এ প্রক্রিয়ায় তৈরি হওয়া নতুন সরকারকে আমদানি করা সরকার বলে বর্ণনা করেন। একই সঙ্গে তিনি ভারতের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির প্রশংসা করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় নওয়াজ শরিফের মেয়ে মরিয়ম নওয়াজ তাকে ভারতে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
সূত্র :দ্য ডন, এপপ্রেস ট্রিবিউন ও জিওটিভি