রবিবার, ৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১

পথশিশুকে অপহরণের পর চার বছর আটকে রেখে নির্যাতন

প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২২ | ৪:১৩ অপরাহ্ণ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২২ | ৪:১৩ অপরাহ্ণ
পথশিশুকে অপহরণের পর চার বছর আটকে রেখে নির্যাতন

চার বছর আগে রাজধানীর গুলশান থেকে বিক্রির উদ্দেশ্যে এক মেয়ে পথশিশুকে অপহরণ করা হয়। পরে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার একটি বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে শিশুটিকে জোরপূর্বক আটকে রেখে চলে অমানবিক নির্যাতন। সুনির্দিষ্ট এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওই শিশুকে উদ্ধার এবং অপহরণকারীকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

গ্রেপ্তার ওই অপহরণকারীর নাম মো. আব্দুল্লাহ (৩৯)। তিনি খিলগাঁওয়ের এল ব্লকের মৃত নুরুল ইসলামের ছেলে। রোববার (১৮ ডিসেম্বর) রাতে তাকে গুলশান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সোমবার (১৯ ডিসেম্বর) দুপুরে র‌্যাব-৩ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ এসব তথ্য জানান।

তিনি বলেন, ২০১৮ সালে এক হতদরিদ্র পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মেয়ে জীবিকার তাগিদে রাস্তায় ফুল ও কাগজের স্টিকার বিক্রি শুরু করে। প্রতিদিনের মতো শিশুটি ফুল বিক্রি করতে রাস্তায় যায় এবং দিন শেষে সে আর বাসায় ফেরেনি। মেয়েকে বাসায় আসতে না দেখে তার বাবা-মা হন্যে হয়ে বিভিন্ন জায়গায় সন্ধান করতে থাকে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একপর্যায়ে শিশুটির বাবা-মা গুলশান থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করেন। ডায়েরি করার ৪ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও কোনো খোঁজ না পেয়ে তারা র‌্যাব-৩ এ পুনরায় একটি অভিযোগ করেন।

সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এবং গুলশান থানায় নিখোঁজ ডায়েরির ভিত্তিতে র‌্যাব-৩ ছায়া তদন্ত শুরু করে। পরে জানা যায়, তাদের মেয়েকে অপহরণ করে গ্রেপ্তার আসামি নিজ বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে আটকে রেখে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করে আসছে।

এ তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব-৩ এর একটি আভিযানিক দল গতরাতে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। এসময় চার বছর আগে অপহরণ হওয়া শিশুটিকে উদ্ধার করে এবং অপরহণকারী আব্দুল্লাহকে গ্রেপ্তার করা হয়।

র‌্যাব-৩ এর জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার আব্দুল্লাহ জানান, ২০১৮ সালে সেপ্টেম্বরে গুলশান এলাকার আজাদ মসজিদের সামনের ফুটপাতে তিনি শিশুটিকে ফুল ও কাগজের স্টিকার বিক্রি করতে দেখতে পান। সেখান থেকেই টার্গেট করেন এবং বেশ কয়েকদিন তাকে অনুসরণ করতে থাকেন। এরপর একদিন বিকেলে ফুল বিক্রি করার সময় অপহরণকারী শিশুটিকে ডেকে তার নাম জিজ্ঞেস করে। সেসময় তাকে নতুন পোশাক কিনে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে শিশুটিকে একটি মার্কেটে নিয়ে যান।

নতুন পোশাকসহ বিভিন্ন ধরনের খেলনা কিনে দিয়ে শিশুটিকে তিনি তার স্টিলের কারখানায় নিয়ে যান। কারখানায় নিয়ে গিয়ে শিশুটিকে ৭/৮ দিন রাখা হয়। এরপর তাকে স্থানীয় এক দালালের কাছে গৃহকর্মী হিসেবে ২০ হাজার টাকায় বিক্রির জন্য বায়নাপত্র করা হয়।

কিন্তু কারখানায় থাকার ফলে খাবার এবং পর্যাপ্ত আলো বাতাসের অভাবে শিশুটি অসুস্থ হয়ে যায়। এতে দালাল শিশুটিকে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে শিশুটি অতিমাত্রায় অসুস্থ হয়ে পড়লে একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে আব্দুল্লাহ শিশুটিকে তার নিজ বাসায় নিয়ে যান। এরপর তাকে দিয়ে গৃহকর্মীর সব ধরনের কাজকর্ম করাতে থাকেন।

জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার আব্দুল্লাহ আরও জানান, তিনি মূলত অর্থের লোভে শিশুটিকে চড়ামূল্যে বিক্রির আশায় অপহরণ করেছিলেন। কিন্তু আশানুরূপমূল্যে বিক্রি করতে না পারায় তারা নিজ বাসায় গৃহকর্মীর কাজে নিয়োজিত করেন।

র‌্যাব-৩ এর সিও লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন বলেন, উদ্ধার হওয়া শিশুটি জবানবন্দিতে বলেছে, অপহরণের পর আটক থাকাকালীন বাবা-মার কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য আব্দুল্লাহর কাছে অনেক কাকুতি-মিনতি করেছে। তবে তাতে কোনো লাভ হয়নি। শিশুটি তার বাবা-মার কাছে ফিরে যেতে প্রতিনিয়তই কান্নাকাটি করে। এছাড়া আব্দুল্লাহের বাসায় যারা নিয়মিত যাতায়াত করতেন, তাদের অনেকের কাছেই শিশুটি তার বাবা-মার বস্তির ঠিকানা জানিয়ে সেখানে তাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করত।

এসব দেখে আব্দুল্লাহ এবং তার স্ত্রী শিশুটিকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধামকি এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করতেন। শিশুটি তার বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করলে তার ওপর অমানসিক নির্যাতনের পরিমাণ বেড়ে যেত। এভাবেই নির্যাতনের শিকার হয়ে আব্দুল্লাহর গৃহকর্মী হিসেবে সে চার বছর কাটিয়ে দেয়।

গ্রেপ্তার হওয়া আব্দুল্লাহ সম্পর্কে র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক বলেন, ২০০২ সাল থেকে তিনি খিলগাঁও এলাকায় স্টিলের ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন।

এদিকে ভুক্তভোগী শিশুটি চার বছর আগে অপহরণ হওয়ার সময় ১২ বছরের এক নাবালিকা ছিল। বর্তমানে তার বয়স ১৬ বছর। সে ১০ বছর বয়স থেকে গুলশানের বিভিন্ন রাস্তায় ফুল ও কাগজের স্টিকার বিক্রি করে অভাব অনটনের সংসারে আর্থিকভাবে সহায়তা করত।

ভুক্তভোগী শিশুটির বাবা সিটি কর্পোরেশনের পরিছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। বর্তমানে তিনি রিকশাচালক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করছেন। শিশুটির মা গৃহকর্মী হিসেবে মানুষের বাসায় কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। শিশুটির দুই ভাই-বোন রয়েছে। তারাও রাস্তায় ফুল ও স্টিকার বিক্রি করে বাবা-মাকে সাহায্য করে। গ্রেপ্তার আব্দুল্লাহের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

সম্পর্কিত পোস্ট