একতলা ভবন। তাতে একাধিক কক্ষ। একটি কক্ষে বড়জোর দুইজনের থাকার জায়গা। কিন্তু সেখানেই গাদাগাদি করে থাকেন ১৪ থেকে ১৬ জন। একজনের থাকার বিছানায় ঘুমান তিনজন। এমনকি রান্নাঘরেও থাকার জন্য বিছানা পাতা আছে।
সেখানকার বাসিন্দা মোহাম্মদ সাগর বলেন, ‘মূলত আমরা জেলখানায় আছি। এটা যদি ভাবেন যে, আমরা ইউরোপে আছি এটা ভুল করবেন। আপনি ভাবতে পারেন আমি ইউরোপে আছি, কিন্তু আমি জানি যে আমি জেলখানায় আছি।
পশ্চিম গ্রিসের এলিস অঞ্চলের এই ভবনটি আগে কী হিসেবে ব্যবহার হয়েছে তা নিশ্চিত করে জানেন না কেউ। কারো মতে এটি কারখানা ছিল, কেউ মনে করেন গুদামঘর।
তবে সাগর জানান, একটা সময় নাকি এখানে দুম্বা রাখা হতো বলে শুনেছেন তিনি। তার কথায়, ‘তারা আগে দুম্বা রাখত এখানে। এখন আমরাই দুম্বা হয়ে গেছি।’
১০০ টাকার ৩০-৪০ টাকা নেয় ‘মাস্তুরা’
বর্তমানে ৩০ জন বাংলাদেশি আছেন এখানে। তবে কৃষি মৌসুমে ১৫০ জনের উপরেও থাকেন তারা। বাংলাদেশি মধ্যসত্ত্বভোগীর মাধ্যমে তারা কাজ নেন কৃষিখামারগুলোতে। যাদেরকে তারা ‘মাস্তুরা’ নামে ডাকেন।
এই মাস্তুরাদের বিরুদ্ধে অনিয়মিত অভিবাসীদের আছে নানা অভিযোগ। সাগর জানান, ‘নয়ন মাস্তুরা’ নামের এক বাংলাদেশি গ্রিকদের সঙ্গে চুক্তি করে তাদের এখানে থাকার ও কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ৩০ টাকা যদি রোজ হয় তাহলে মাস্তুরা এক টাকা কেটে ২৯ টাকা দেন তাদের।
তিনি বলেন, ‘মাসে কত ডিউটি করবেন তার ওপরে নির্ভর করবে আপনি তাকে কত টাকা দেবেন। ১০টা ডিউটি করলে মাস শেষে তাকে ১০ টাকা দিতে হবে। এর ওপর বাসা ভাড়া দেবেন, ব্যাংকের চেকের ফি শতকরা তিন টাকা দেবেন। যেহেতু অবৈধ হওয়ায় আমাদের কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। ১০০ টাকা বেতনের কাজ করলে ৭০ টাকা আমরা পাই। ৩০-৪০ টাকাই মাস্তুরা নিয়ে নেয়।’
কাগজ না থাকায় শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো সুযোগ-সুবিধা দাবি করতে পারেন না তারা। কেননা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে গেলে উল্টো তাদেরই হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সাগর বলেন, ‘বাঙালি যে জায়গায় আছে সেখানেই মাস্তুরা আছে। মাস্তুরা ছাড়া কাজ করা সম্ভবই না।’
আরেক অভিবাসী বলেন, ‘কেউ যদি মাস্তুরাদের বাদ দিয়ে নিজে সরাসরি খামার মালিকের অধীনে কাজ করতে চায়, সে এখানে টিকতে পারে না। তাদের এখানে সিন্ডিকেট আছে। তারা এখান থেকে আপনাকে একবারে বের করে দেবে।’
‘স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের মিল নাই’
মোহম্মদ শাহজাহান দুই বছর ধরে আছেন এখানে। সিলেট থেকে ওমান আসেন তিনি। পরে সড়ক পথে ইরান পাড়ি জমান। এরপর অনেক চেষ্টার পর গ্রিসে পৌঁছান। এখন তিনি স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি খামারে কাজ করেন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের তো আর বৈধতা নাই। আমরা এক বাংলাদেশির অধীনে একজন গ্রিকের জন্য কাজ করি এখানে। ও যেভাবে বলে সেভাবেই আমাদের বাধ্যতামূলকভাবে মেনে নিতে হয়। এখানে থাকার পরিস্থিতি নাই তারপরও বাধ্য হয়ে থাকতে হচ্ছে। ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে তার গ্রিসে পৌঁছাতে, যার অনেকটাই ঋণ করেছেন।’
২০১৯ সালে গ্রিসে এসে এথেন্সে সাত মাস জেল খেটেছেন আরেক বাসিন্দা সালাউদ্দিন। এরপর ছাড়া পেয়ে কয়েকদফা আবেদন করেও বৈধভাবে থাকার অনুমতি পাননি তিনি। বলেন, ‘আমি শহরে থেকে ধরা খেয়েছি। এখন যদি আবার ধরা খাই আবার জেল খাটতে হবে। এজন্য এদিকে চলে এসেছি। এখানে দুই টাকা কম আয় হলেও পুলিশের হয়রানি নেই।’
আজিজুর রহমান নামে আরেকজন বলেন, ‘যে চিন্তা করে এসেছি সেই স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের মিল নাই। আমরা নানাবিধ সমস্যায় আছি। বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারছি না। বৈধ কার্ডের কোনো ব্যবস্থাও হচ্ছে না।’
ফেব্রুয়ারিতে গ্রিসের সঙ্গে বাংলাদেশ কর্মী পাঠানোর একটি চুক্তি করেছে। সম্প্রতি গ্রিসের পার্লামেন্টের অনুমোদন দিয়েছে। এই চুক্তি অনুযায়ী দেশটিতে বসবাসরত ১৫ হাজার অনিয়মিত বাংলাদেশিকে মৌসুমি কাজের অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে নথিভুক্ত করার কথা রয়েছে।
কিন্তু মোহাম্মদ শাহজাহান মনে করেন এতে তাদের খুব একটা সুবিধা হবে না। তিনি বলেন, ‘আমরাতো পরিবার ফেলে এসেছি ভবিষ্যতের জন্য। চুক্তিবদ্ধ হলে যদি পাঁচ বছর পর দেশে চলে যেতে হয় তাহলেতো আর হলো না। আমি এত টাকা পয়সা পরিশ্রম করে এখানে এসেছি নিজের জীবন প্রতিষ্ঠা করার জন্য।’
আজিজুর বলেন, চুক্তি অনুযায়ী তাদের যদি প্রতি নয় মাস কাজের পর বাংলাদেশে ফেরত যেতে হয় তাহলে আয়ের টাকা আর অবশিষ্ট থাকবে না। এতে কোনো সুফল হবে না। ‘বরং আগের যে কার্ডের নিয়ম সে অনুযায়ী দিলে আমরা দুই তিন বছর পর ইচ্ছামতো দেশে যেতে পারব। আর এত টাকা খরচ করে এসেছিই আমরা মূলত ইউরোপে স্থায়ী হওয়ার জন্য’, বলেন তিনি।
‘কপালে যতদিন আছে ঝুঁকি নিতে হবে’
এই অভিবাসীদের বেশিরভাগই বাংলাদেশের সঙ্গে গ্রিসের করা চুক্তির অধীনে নিয়মিত হওয়ার আবেদন করতে ইচ্ছুক নন। সালাম নামের একজন বলেন, ‘এই কাগজ নেওয়ার চেয়ে না নেওয়া ভালো। আমরা ইউরোপ আসছি এত কষ্ট করে। আমরা এসেছি জীবনের নিরাপত্তার জন্য। পাঁচ বছরের জন্য যেই কাগজ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে সেটা আমি নেব না। আমি ইতালি বা ফ্রান্সে চলে যাব।’
কিন্তু ইতালি বা ফ্রান্স যাওয়ার পথে আরও ঝুঁকিওতো রয়েছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে সালাম বলেন, ‘আমরা এমন একটা দেশে জন্ম নিয়েছি আমাদের জীবনটাই ঝুঁকি। জন্মের পর থেকেই আমরা ঝুঁকিতে আছি। আমাদের কপালে যতদিন আছে ঝুঁকি নিতে হবে।’
তিনি অভিযোগ করেন, প্রবাসী কেউ মারা গেলেও বাংলাদেশের সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয় না। সম্প্রতি তারা নিজেরাই এক প্রাবাসীর লাশ পাঠিয়েছেন চাঁদা তুলে। দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে অভিযোগ তাদের।
সূত্র: ডয়চে ভেলে/ইনফোমাইগ্রেন্টস