বই পড়া অনেকের কাছে একটি শখের বিষয়। শখের বশে বই পড়া ছাড়াও জানার জন্য, জ্ঞানের পরিসর বাড়াতে এবং জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করতে বই পড়ার কোন বিকল্প নেই। বই পড়া মানসিক প্রক্রিয়াকে সক্রিয় রাখে। বই পড়লে মস্তিষ্ক চিন্তা করার খোরাক পায়, সৃজনশীলতা বাড়ে এবং তথ্য ধরে রাখার ক্ষমতা সৃষ্টি হয়। বই পড়লে মানুষ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক মনস্ক হয়ে ওঠে।
মানব জীবনে বইয়ের গুরুত্বের কথা স্মরণ করে টলস্টয় বলেছেন, ‘জীবনে মাত্র তিনটি জিনিসের প্রয়োজন বই, বই এবং বই।’
জ্ঞানার্জনের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে বই। জীবনকে সফলতার আলোয় আলোকিত করার প্রধান উপায় হচ্ছে বই। বই পড়েই জ্ঞানার্জন করতে হবে। পৃথিবীতে যারা বড় হয়েছেন, জগদ্বিখ্যাত সফল মানুষ হয়েছেন, তারাই বেশি বেশি জ্ঞান অন্বেষণে সময় দিয়েছেন। পৃথিবীর যে কোনো বরেণ্য মনীষীদের জীবন ইতিহাস ঘাঁটলে এ কথার সত্যতা ধরা পড়ে। বই হচ্ছে শেখার, জানবার ও জ্ঞানার্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম।
ছোটবেলা থেকে আমার বই পড়ার অভ্যাস ছিল। এখন যদিও নানা ব্যস্ততার কারণে সেভাবে বই পড়া হয়ে উঠেনা। অবশ্য লেখালেখির কারণে তথ্য জানতে বই পড়ার চেষ্টা করি। তবে আমি মনে করি, একটি ভাল বই জ্ঞানের পরিসীমা বৃদ্ধি করে। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি ভালো বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন। কারণ, বই পড়ার অভ্যাস থাকলে মন্দ সকল কাজ ও চিন্তা থেকে দূরে থাকা যায়। তাছাড়া কাজে লাগে নানা সময়। এখনকার ছেলেমেয়েরা বই পড়ার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে চায়না। তারা ইন্টারনেট এর নানা গেমস ও অনলাইন কন্টেন্ট নিয়ে পড়ে থাকে। খাবারদাবার পর্যন্ত ভুলে যায়। এ কারণে সমাজে দিন দিন নীতি-নৈতিকতার সংকট বাড়ছে। বাড়ছে কিশোর অপরাধ। তার উপর করোনার কারণে অনেকদিন স্কুল, কলেজ বন্ধের সুযোগে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়। এসব কারণে বই পড়ার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
ভালো লেখকের বই পড়ার মজাই আলাদা। নাওয়া খাওয়া ভুলে একসময় বিভিন্ন গোয়েন্দা সিরিজ, গল্পের বই, ধর্ম ও বিভিন্ন সাহিত্যের বই পড়ার চেষ্টা করতাম। আমার সংগ্রহে অনেক বই ছিল। মাঝে বইগুলোর অনেকাংশ হারিয়ে ফেলি। তাছাড়া, আমার আরেকটি অভ্যাস ছিল। আর সেটা হলো লাইব্রেরিতে গেলেই বই কেনা। সাধারণ জ্ঞান, গল্পসহ বিভিন্ন বিষয়ের বই কিনতাম। অনেকে আছে বইয়ের পোকা। তাদের মধ্যে কেউ আছে যারা পাঠ্যবই পড়ায় দিনরাত সময়টা দিয়ে দেয়। আবার অনেকে আছে যারা শুধু গল্প বা পাঠ্যবইবহির্ভুত বিভিন্ন বই নিয়ে পড়ে থাকে। আসলে বই পড়াকে নিজের সাথে মানিয়ে নিতে হয়। আমি মনে করি ব্যস্ততার মাঝেও কিছু সময় বের করা উচিত বই পড়ার জন্য।
বই-ই একমাত্র বন্ধু যার সাথে কোনসময় শত্রুতা তৈরি হয়না। বই মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যায়। সেজন্য বইয়ের সাথে সম্পৃক্ততা বাড়ালে উপকারই হয়। ভালো কিছু খুঁজে নেওয়া যায়। আজকাল বইকে বগলদাবা করে চলতে হয় না। ইন্টারনেটে সার্চ দিলেই কাংখিত বইয়ের পুরোটাই চলে আসবে। সেখান থেকেও বই পড়া যায়। মূলত: বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলাই মূল লক্ষ্য।
বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে দেশে খুব বেশি উদ্যোগ নেই। যা আছে তাতে কাংখিত ফল আসছেনা। বিভিন্ন পাঠাগার ও ক্লাব থাকা সত্ত্বেও পাঠক তৈরি হচ্ছে খুবই কম। যদিও দেশে প্রতিবছরই কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিকভাবে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রকাশিত হয় পরিচিত, নতুন লেখকদের বই। ব্যক্তি উদ্যোগেও অনেককে দেখা যায় বইয়ের প্রতি মানুষকে আগ্রহী করে তুলতে। পাঠ্যাভ্যাস তৈরি করার জন্য দেশে প্রচুর পাঠাগার কিংবা গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। পাশাপাশি মানুষকে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে ব্যাপকভিত্তিক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বই পড়ার আন্দোলন আরো বেগবান হবে।
বই পড়ার আনন্দ সে পায় যে সেটা বুঝেছে। কারণ, অনেককে দেখেছি বই পড়তে গিয়ে নিজের দিকেও ঠিকমতো মনোযোগ দেওয়ার সময় পায়না। বহু ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ একবার স্কুলে পড়ার সময় লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ায় এমন মনোযোগী ছিলেন কখন যে দপ্তরি দরজা বন্ধ করে চলে গেছে সেটা টেরও পাননি। পরে দপ্তরিকে ডেকে বিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে বের হন।
নরডিক অঞ্চলের এক ছোট্ট দেশ আইসল্যান্ড। দ্বীপদেশটির দুই পাশে আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তরাংশ আর আর্কটিক সাগর। শীতপ্রধান দেশটির আয়তন বাংলাদেশের কাছাকাছিই। ৪০ হাজার বর্গমাইলের মতো। তাতে বাস করে মাত্র তিন লাখের কিছু বেশি মানুষ। বই পড়ার হারে বিশ্বের সবচেয়ে এগিয়ে এই ছোট্ট বরফের দেশটিই। এখানকার মানুষই গড়ে সবচেয়ে বেশি বই পড়ে।
পুরো বিশ্বে কে সবচেয়ে বেশি বই পড়েছে, সেটা সঠিকভাবে জানা সম্ভব না। তবে ব্রিটেনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বই পড়েছেন সেখানকার ৯১ বছর বয়সী নারী লুইজ ব্রাউন। এক হাজার নয়, দুই হাজার নয়, পুরো ২৫ হাজার বই পড়েছেন এই নারী। তা-ও কেবল গ্রন্থাগার থেকে নিয়েই। আর এর বাইরে কতগুলো বই পড়া হয়েছে, সেটা তার জানা নেই সঠিক। শুরুটা হয়েছিল সেই ১৯৪৬ সালে। এর পর থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ডজনখানেক করে বই পড়ে শেষ করেছেন লুইজ। আর কখনো তার বইগুলো ফিরিয়ে দিতে একটুও দেরি হয়নি। ঠিক সময় আর নিয়ম মেনেই বই শেষ করেছেন এই নারী। পড়ার ক্ষেত্রে সব সময় একটু বড় অক্ষরের বইগুলোকেই বেছে নিয়েছেন লুইজ। বই পড়া শুরু হয় তার মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকে। এর পর থেকে আর পড়াশোনা থামাননি তিনি।
দেশ ও জাতি গঠনে বইয়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির অগ্রগতি সম্ভব নয়। আর সহজ উপায়ে মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো ছড়াতে সমাজের জন্য বই অপরিহার্য। বইয়ের বিকল্প আর কিছুই হতে পারে না। বই পড়ার প্রতি আমাদের আরো মনোযোগী হতে হবে। বই পড়া এবং বইয়ের প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে একটি সুন্দর ও শিক্ষাবান্ধব সমাজ গড়ে তোলাই হোক আমাদের সকলের অঙ্গীকার।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
( প্রিয় পাঠক, আপনিও মূল্যবান মতামত জানিয়ে লিখুন সময়ের সংলাপে। আপনার পাঠানো লেখা প্রকাশের উপযোগী হলে পাঠক মতামত-এ তা প্রকাশ করা হবে। news.somoyersonglap@gmail.com এই ঠিকানায় লেখা পাঠাতে হবে। – নির্বাহী সম্পাদক )