দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুধার্ত মানুষের খাবার নিশ্চিতে সবাইকে এক হয়ে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে এ লক্ষ্য অর্জনে এই অঞ্চলের দেশগুলোকে নিজেদের মধ্যে কৃষি গবেষণা ও শিক্ষা সহযোগিতা বাড়ানো, প্রযুক্তি বিনিময় এবং কৃষি অর্থায়নে বিশেষ আঞ্চলিক তহবিল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের খাদ্য এবং কৃষি সংস্থার (ফাও) ৩৬তম এশিয়া এবং প্যাসিফিক আঞ্চলিক কনফারেন্সে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানোর আহ্বান জানান। বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো এ আঞ্চলিক কনফারেন্সের আয়োজন করেছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের উপরাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী ও দুবাইয়ের শাসক মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুমের আমন্ত্রণে আবুধাবি সফরে আসা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সফরকালীন আবাসস্থল থেকে আন্তর্জাতিক এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এ সময় তিনি আঞ্চলিক এই কনফারেন্সের উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘নিশ্চয়ই খাদ্য নিরাপত্তা জনগণের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৩০৫ দশমিক ৭ মিলিয়ন মানুষ এখনো ক্ষুধার্ত। আমরা সবাই যদি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করি তাহলে সহজে তাদের সবার খাবারের ব্যবস্থা করতে পারি।’
যেকোনো সংকট মোকাবিলায় সব দেশ-জাতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারি দেখিয়েছে এই ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় মানুষ কতটা অসহায়। এ মহামারী আরও দেখিয়েছে সবাই এক হয়ে কিভাবে এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়।’
এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে তিনটি প্রস্তাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথম প্রস্তাবে সহযোগিতা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এশিয়া এবং প্যাসিফিক অঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে কৃষি গবেষণা ও শিক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর সুপারিশ করছি।’
দ্বিতীয় প্রস্তাবে শেখ হাসিনা এই অঞ্চলের ‘ফাও’ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে কৃষি ক্ষেত্রে বায়োটেকনোলজি, ন্যানোটেকনোলজি এবং রোবটিক্সের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি হস্তান্তর ও জ্ঞান বিনিময় বাড়ানোর কথা বলেন।
আঞ্চলিক তহবিল গঠনের সুপারিশ করে তৃতীয় প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আধুনিক কৃষিতে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন, তাই কৃষিতে অর্থায়ন ও সহায়তার জন্য বিশেষ তহবিল তৈরি করা যেতে পারে।’
চলমান করোনা মহামারিতে কৃষির ক্ষতির কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অন্যান্য সেক্টরের মতো কোভিড-১৯ মহামারি কৃষি খাততে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ২০২০ সালে মহামারির শুরুতে প্রাথমিকভাবে কৃষির সরবরাহ চেইন বিপর্যস্ত হয়েছে। এর ফলে এ খাতের উৎপাদক এবং ভোক্তা উভয়ই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
আমাদের সময়মত এবং কার্যকর পদক্ষেপ এই সেক্টরটিকে দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করেছে। আমরা যান্ত্রিকীকরণসহ অব্যাহতভাবে খাদ্য উৎপাদন এবং সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছি, যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশের কৃষি খাতের অবস্থা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যদিও জিডিপিতে কৃষি খাতের গুরুত্ব আপেক্ষিকভাবে কমে যাচ্ছে, কিন্তু সার্বিকভাবে অবদান (absolute contribution) কমেনি, বরং বেড়েছে। ২০০৫-০৬ সাল থেকে কৃষি জিডিপি ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।’
টানা তিনবারের সরকার প্রধান বলেন, ‘কৃষি এখনো কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস হিসেবে রয়ে গেছে। এর ওপর ৪০ শতাংশ শ্রমশক্তি জীবিকা নির্বাহ করে। বর্তমানে প্রায় ২২ দশমিক ৭ মিলিয়ন মানুষ সরাসরি কৃষি খাতে কাজ করছেন, যার মধ্যে ৪৫ শতাংশ নারী। এ ছাড়াও এখন অনেক কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প চাল, চিনি, চা, ফলের রস, মসলা, ভোজ্যতেল, তামাক, পাট বস্ত্র, তুলা বস্ত্র, স্টার্চ এবং অন্যান্য মৌলিক কাঁচামালের জন্য পুরোপুরি কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এভাবে কৃষি এখনো বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে রয়ে গেছে। গত ১৩ বছরে বাংলাদেশ ধান, সবজি, ফল, মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছে। বছরে প্রায় ৩৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন চাল উৎপাদন করে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিশ্বে বাংলাদেশ পাট ও মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয়, ধান ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, চা উৎপাদনে চতুর্থ, ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম।’
কৃষক এবং কৃষি উদ্যোক্তাদের প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সরকারের অব্যাহত নীতিগত সহায়তা ও প্রণোদনা এবং আমাদের কঠোর পরিশ্রমী কৃষকদের প্রচেষ্টার কারণে এই অর্জনগুলো সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়াও উদ্যোক্তারা একটি সমৃদ্ধ বেসরকারি খাত তৈরি করেছে যেখানে কৃষি ক্রমবর্ধমান এবং সম্প্রসারিত হচ্ছে।’
খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে কৃষিতে আরও পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এত সফলতা সত্ত্বেও আমরা বুঝি প্রকৃত অর্থে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের জন্য আমাদের আরও অনেক কিছু করতে হবে। কারণ এই সেক্টরে প্রকৃতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অস্বাভাবিকতা বার বার আঘাত হানে।’
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘টেকসই কৃষির জন্য জলবায়ু পরিবর্তন অনেক বড় হুমকি। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবগুলো মোকাবিলার করার জন্য আমরা আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিল থেকে বিভিন্ন অভিযোজন এবং প্রশমন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি।’
পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাগুলো মোকাবিলায় বাংলাদেশ ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান’ এবং ‘ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’ গ্রহণ করার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
গবেষণার ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের বিজ্ঞানীরা বন্যা-খরা প্রতিরোধী এবং লবণাক্ততা সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছেন যা কঠিন পরিবেশে জন্মানো যেতে পারে।’
বাংলাদেশের জীবিকা নির্ভর কৃষি এখন বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের উচ্চমানের খাদ্য উৎপাদন এবং কমমূল্যের খাদ্যের মূল্য সংযোজন প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে খাদ্য বহুমুখীকরণের ওপর জোর দিতে হবে। টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করতে আমরা যান্ত্রিকীকরণ, ভাসমান কৃষি, ছাদ কৃষি, হাইড্রোপনিক এবং অ্যারোপোনিক চাষ এবং সমন্বিত চাষসহ অত্যাধুনিক কৃষি অনুশীলন পদ্ধতিতে যাচ্ছি।’
বাংলাদেশের সমাজে কৃষকরা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত ছিল উল্লেখ করে তাদের কৃষি ও কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নের সরকারে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
১০ টাকায় কৃষকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার উদ্যোগের কথা তুলে ধরে সরকার প্রধান বলেন, এক দশক আগেও তাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সহজে প্রবেশাধিকার ছিল না।
তিনি জানান, তার প্রথম মেয়াদে, তার সরকার কৃষকদের কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড বিতরণ করেছে এবং তাদের জন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করেছে। এখন প্রায় ২০ মিলিয়ন কৃষকের সহায়তা কার্ড আছে এবং যার মাধ্যমে তারা সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা সহায়তা পেয়ে থাকে এবং সরকারের দেওয়া অর্থ সরাসরি তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পৌঁছে যায়।
কৃষি ও কৃষকদের উন্নয়নের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কৃষকদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু ‘সবুজ বিপ্লবের’ ডাক দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু তার ক্ষমতার সাড়ে তিন বছরে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে অনেকগুলো ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের ২৯তম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আসুন আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ এমন এক বিশ্ব গড়ে তুলি যা দারিদ্র, ক্ষুধা, যুদ্ধ এবং মানুষের কষ্ট দূর করতে পারে এবং মানবতার কল্যাণের জন্য বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জন করতে পারি।’
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকের সভাপতিত্বে এ সময় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মৎস্য ও প্রাণীসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, কৃষি সংস্থা (ফাও) মহাপরিচালক ক্যু ডংইয়ু (QU Dongyu)।