দেড় বছর আগে কুমিল্লার নেউরা ডুলিপাড়া এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মাদ নাজিউর রহমান পাড়ি জমান ইউক্রেনে। তার কর্মস্থল দেশটির রাজধানী কিয়েভে। যুদ্ধ শুরুর পর চলে যান পোল্যান্ডে।
মোবাইল ফোনে নাজিউর রহমান জানান, গত পরশু রাত থেকে হঠাৎ করে বোম্বিং শুরু হয়। কিন্তু কোথায় থেকে এই বোম্বিং হয় তার বুঝতে পারিনি। শুধু মোবাইল ফোন ও চার্জার নিয়ে বের হয়েছেন। সে জানায়, গত তিন দিন তার অফিস ও যে অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন সেখানে বোমা বর্ষণ করা হয়। জান বাঁচাতে গিয়ে একটি বাঙ্কারে আশ্রয় নেন। সেখানে আরও অন্তত ৫০ জন শিশু বৃদ্ধসহ আশ্রয় নিয়েছেন। খেয়ে না খেয়ে কীভাবে সীমান্তে যাওয়া যায় সে অপেক্ষা করছিলামা। এমন চিন্তা করে কয়েকবার বাঙ্কার থেকে বের হয়ে ব্যর্থ হন। এর মধ্যে খবর পান তার ভারতীয় মেডিকেল পড়ুয়া দুই বন্ধু বোমা বর্ষণে নিহত হয়েছেন। শনিবার সকালে আরও বেশ কয়েকজনের সঙ্গে তিনি একটি ট্রেনে করে ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ইউক্রেনের সীমান্তে আসেন। তারপর সেখান থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পোল্যান্ডের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন।
শুধু নাজিউর নন, ইউক্রেন ত্যাগ করে পোল্যান্ডে ঢুকতে ইউক্রেনীয়দের সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন বাংলাদেশিরাও। ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় ৪০০ বাংলাদেশি ইউক্রেন ছেড়ে পোল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছেন। এর মধ্যে ১৫ জন বাংলাদেশি হাঙ্গেরিতে পৌঁছেছেন ও তিনজন রোমানিয়ায় পৌঁছেছেন। আর ২৮ জনকে রেডক্রসের মাধ্যমে পোল্যান্ডে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে ওয়ারশ দূতাবাস।
গতকাল সন্ধ্যায় এক বিজ্ঞপ্তিতে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রায় ৪০০ বাংলাদেশি নিরাপদে ইউক্রেন সীমান্ত অতিক্রম করে পোল্যান্ডে পৌঁছেছেন। এদের মধ্যে ৪৬ জন বাংলাদেশি ওয়ারশতে বাংলাদেশ দূতাবাসের ব্যবস্থা করা অস্থায়ী আশ্রয়ে রয়েছেন। দূতাবাস আইসিআরসি, ইউক্রেনের মাধ্যমে ২৮ বাংলাদেশি নাগরিককে উদ্ধার ও স্থানান্তরের জন্য কাজ করছে। দূতাবাস আইওএম, ইউক্রেনের মাধ্যমে দেশটির কারাগারে আটক বাংলাদেশিদের সরিয়ে নিতেও কাজ করছে।
অন্যদিকে, ১৫ জন বাংলাদেশি হাঙ্গেরিতে পৌঁছেছেন। এসব বাংলাদেশিকে বর্তমানে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় বাংলাদেশ দূতাবাস দেখাশোনা করছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। তারাও এখন বাংলাদেশে ফিরতে ইচ্ছুক। এ ছাড়া রোমানিয়ায় এখন পর্যন্ত তিনজন বাংলাদেশি প্রবেশ করেছেন। তাদের দেখাশোনা করছে বুখারেস্টের বাংলাদেশ দূতাবাস। শীঘ্রই আরও সাত বাংলাদেশি রোমানিয়ায় প্রবেশ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। তারাও অবিলম্বে বাংলাদেশে ফিরতে ইচ্ছুক। বাংলাদেশ সরকার তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করছে। এ ছাড়া ইউক্রেনে আটকে পড়া বাংলাদেশি নাগরিকদের দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশে ফেরত ও সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি সমন্বয়ের জন্য পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম এবং ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব শাব্বির আহমেদ চৌধুরী গতকাল রাতে পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া এবং রোমানিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন।
পোল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা হোসেন জানিয়েছেন, ইউক্রেন-পোল্যান্ড সীমান্তে বাংলাদেশি দূতাবাসের একটি দল কাজ করছে। বাংলাদেশ দূতাবাস এবং পোলিশ সরকার যৌথভাবে পোল্যান্ডে আগতদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
অস্ট্রিয়াতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মাদ আবদুল মুহিত টুইট বার্তায় জানান, ইউক্রেনে পড়াশোনারত ১৫ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে হাঙ্গেরি-ইউক্রেন সীমান্তে তাদের স্বাগত জানান অস্ট্রিয়াতে বাংলাদেশ মিশনের উপ-প্রধান রাহাত বিন জামান। হাঙ্গেরিতে বাংলাদেশের অনারারি কনসাল গ্রেগ পাটাকিও ওই সময়ে উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষার্থীদের বুদাপেস্টে নিয়ে যাওয়া এবং সিলেওয়েস বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। রাষ্ট্রদূত আবদুল মুহিত হাঙ্গেরির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সহায়তা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
আটকা পড়েছে বাংলাদেশি দুটি জাহাজ : যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনে আটকা পড়েছে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের দুটি জাহাজ- এমটি বাংলার অগ্রদূত এবং এমভি বাংলার সমৃদ্ধি। এর মধ্যে এমভি বাংলার সমৃদ্ধি ইউক্রেনের অলিভিয়া বন্দরে আটকা পড়েছে। তবে এমটি বাংলার অগ্রদূত রাশিয়া নাকি ইউক্রেনের বন্দরে আটকা পড়েছে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। জাহাজ দুটিতে অর্ধশতাধিক নাবিক রয়েছেন।
এমভি বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজে থাকা নাবিক ওমর ফারুক বলেন, আমাদের জাহাজটি অলিভিয়া বন্দরে আটকা পড়েছে। আমরা ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে আটকা পড়েছি। জাহাজে ২৯ জন নাবিক রয়েছে। তারা সবাই আতঙ্কিত অবস্থায় রয়েছেন।
ঢাকায় শিপিং করপোরেশনের এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, জাহাজ দুটিতে থাকা নাবিকদের সঙ্গে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ হচ্ছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি তদারকি করছে।