ভার্সিটির হোস্টেল আর বাসাবাড়ি ছেড়ে জীবন বাঁচানোর একমাত্র আশ্রয় এখন রুদ্ধ বাঙ্কার। স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য কোন সুযোগ সুবিধা দূরের কথা; নেই পানি, বিদ্যুৎ আর পর্যাপ্ত খাবারেরও ব্যবস্থা। প্রয়োজনে বাইরে বের হলেও সাইরেন বাজতেই জীবন বাঁচাতে বাঙ্কারে ঢুকতে হয়। ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এমনটিই।
জানা যায়, গেল (২০২১) বছরের চৌঠা এপ্রিল মেডিকেল শিক্ষার্থী হিসেবে ইউক্রেনের সুমিতে গমন করেন সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী রাকিব খান কাশেমের বড় ছেলে জিয়াউদ্দীন খান ফয়সাল। সুমি স্টেট মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে শুরু করেন পড়াশোনা। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। ছেলের উচ্চ শিক্ষায় খুশির জোয়ারে ভাসছিল পরিবার৷ হঠাৎ বিপর্যয় হয়ে নেমে এলো ইউক্রেনে রূশ হামলা। মুহুর্তে সেখানকার মতোই পাল্টে গেল ফয়সালের পরিবারে চিত্র। কপালে পড়লো দুঃশ্চিন্তার ভাজ। ছেলের জন্য বন্ধ প্রায়- বাবার সকল কাজ, দরজায় কান পাতলে ভেসে আসছে মায়ের কান্নার আওয়াজ। এখন খেয়ে না খেয়ে কাটছে তাদের দিন৷
এদিকে ইউক্রেনে বাংলাদেশ দূতাবাস না থাকায় পাশ্ববর্তী পোল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাস যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে তাদের উদ্ধারের। তবে সড়ক, রেল কিম্বা আকাশ পথে কোন যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় কোন ভাবেই তাদের স্থানান্তর করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে ভিডিও কলে জিয়াউদ্দীন খান ফয়সাল বলেন, “আমরা শিক্ষার্থীসহ নয় জন বাঙ্কারে রয়েছি। প্রয়োজনীয় কাজে বাইরে গেলে একটু পরপরই হামলার সাইরেন বেজে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে বাঙ্কারে চলে আসতে হয়। গ্রোসারি, শপগুলোতে খাবার নেই। আমরা কোন রকমে শুকনা খাবার খেয়ে জীবন নিয়ে বেঁচে আছি আমরা।
” রাশিয়ার যুদ্ধ বিরতির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইউক্রেন ছাড়ার সুযোগ ছিল কী না জানতে চাইলে ফয়সাল বলেন, “যুদ্ধ বিরতির খবর সম্পূর্ণ ভূয়া ও ভিত্তিহীন। এখানে রুশ হামলার শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত কোন বিরতি দেয়া হয়নি। রুশ আর্মিদের দখলে প্রায় গোটা ইউক্রেন। বিমান হামলায় বিদ্ধস্ত চারদিক। এখানকার পাওয়ার প্লান্টে হামলা করে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।
” বাংলাদেশী আরেক শিক্ষার্থী সাব্বির বলেন, ‘সুমি অনেক ঠাণ্ডাপ্রবণ এলাকা। আজ তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ফাইভ ডিগ্রি। বিদ্যুৎ না থাকায় হিটিং সিস্টেম বন্ধ। হিটিং সিস্টেম ছাড়া এখানে থাকা খুবই কঠিন। মোবাইলও ঠিকমতো চার্জ করতে পারছি না। ফোন বন্ধ করে রাখি, যাতে মাঝেমধ্যে অন করে বাসার সঙ্গে যোগাযোগ করার মতো চার্জ অন্তত থাকে।’
সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কিম্বা সরকারি ভাবে কোন সহায়তা না পাওয়াই নিজ দায়িত্বে বাংকারেই সংকটময় জীবনযাপন করছেন ফয়সালসহ নয় বাংলাদেশী নাগরিক। দ্রুত তাদের উদ্ধারের ব্যবস্থা না নিলে যে কোন সময় ঘটতে পারে জীবন সংশয়।
এ প্রসঙ্গে ফয়সালের পিতা রাকিব খান কাশেম বলেন, “ডাক্তারি পড়তে ইউক্রেনে পাঠিয়েছিলাম ছেলেকে। সেখানকার পরিস্থিতি যে এমন ভয়াবহ হবে আগে জানা ছিল না। যুদ্ধ শুরুর আগে ছেলেকে আমাদের কাছে নিয়ে আসতে বিমানে টিকিটও কাটা হয়েছিল। ফ্লাইটের কয়েকদিন আগে হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলো সবকিছু। যে কারণে আর ফেরার সুযোগ হয়নি তার। এখন কোন রকমে ইউক্রেনের সুমি থেকে পোল্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারলে জীবন নিয়ে ফিরতে পারবে আমার ছেলেসহ অন্যরা। আমরা চাই যে কোন মূল্যে আমার ছেলেকে আমাদের কাছে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হোক।”
মাঝেমধ্যে অল্প কিছু সময়ের জন্য অনলাইনে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে তার সঙ্গে। ভিডিও কলে ছেলেকে দেখতে পেলেই হকচকিয়ে উঠছেন মা মাকসুদা খানম ফেন্সি। প্রতিবেশীসহ অন্যকেউ এলেই ছেলেকে ফেরানোর কড়জোর আকুতি জানাচ্ছেন তাদের কাছে। ভেঙে পড়ছেন কান্নায়। দূরালাপনিতে শুধুমাত্র এতটুকু যোগাযোগই এখনও আশা জাগিয়ে রেখেছে তাদের।
কান্না বিজড়িত কন্ঠে মা মাকসুদা বলেন, “আমার একমাত্র ছেলে ফয়সাল। আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। পড়াশোনা করতে গিয়ে যুদ্ধের মধ্যে পড়বে জানলে কখনোই কাছ ছাড়া করতাম না। আমি বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ দূতাবাসগুলোর কাছে করজোড় মিনতি করছি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে দিন।”
উল্লেখ্য, স্ত্রী মাকসুদা খানম ফেন্সী ও দুই মেয়েকে নিয়ে দীর্ঘ ২৪ বছর যাবত সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজায় থাকেন প্রবাসী রাকিব খান কাশেম। কাজ করেন আল আমানিয়া নামক একটি মোটরগ্যারেজের সুপারভাইজার হিসেবে। সেই সূত্রে এখানেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা ফয়সালসহ তিন ভাই বোনের। তাদের দেশের বাড়ি ফরিদপুর জেলার সদরপুর থানার পশ্চিম রামনগর গ্রামে। একই জেলার চরভদ্রাসনে রয়েছে তাদের আরও একটি ঠিকানা। ফয়সাল ও কানিজ ফাতেমা পড়তেন শারজার প্রোগ্রেসিভ ইংলিশ স্কুলের একই ক্লাসে। আরেক মেয়ে সাদিয়া খানম কাকলী একই স্কুলের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। মেডিকেলে উচ্চ শিক্ষার জন্য ইউক্রেনের সুমিতে পাড়ি জমান ফয়সাল।
আটকে পড়া ফয়সালসহ মেডিকেল শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছে সাব্বির, রিফাত ভূইয়া ও রুবায়েত হাবিব। তাদের সঙ্গেই আছেন বাংলাদেশি দুই জন ব্যবসায়ী এবং তাদের একজনের স্ত্রী ও দুই সন্তান। তাদের আশ্রয় নেওয়া বাঙ্কারটি ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার এবং নিকটতম ইউক্রেন-পোল্যান্ড সীমান্ত থেকে প্রায় ৮৫০ কিলোমিটার দূরে।
সংলাপ ০৭/০৩/০১০ আজিজ