
ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে পাড়ি জমানো অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সহজশর্তে নাগরিকত্ব দেওয়াসহ বিশেষ কারণে সম্প্রতি পর্তুগাল বিশ্ব দরবারে আলোচনার তুঙ্গে। অভিবাসীদের প্রশংসা যেন রীতিমতো সরকারের প্রত্যেকটি সেবার ক্ষেত্রে এক গতিশীল প্রতিযোগিতা দেখা গেছে। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ তাদের সম্মান বয়ে এনেছেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে প্রশংসনীয় পর্তুগালের স্বাস্থ্যসেবা।
পর্তুগালে ২০২০ সালের মার্চ মাসের ১ম সপ্তাহ থেকে যখন মহামারি করোনার প্রথম রোগী শনাক্ত করা হয়, ঠিক তার পরের সপ্তাহ থেকেই সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের নিরাপদ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সামনে ওঠে আসে।
যদিও প্রথম করোনারোগী শনাক্ত হওয়ার এক থেকে দেড় মাস আগে দেশটিতে জনসাধারণের জন্য কোভিড-১৯ সম্পর্কিত গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচার-প্রসার শুরু করে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলো হলো জনসম্মুখে চলাচলের ক্ষেত্রে মুখে মাস্ক ব্যবহার করা, নিরাপদ দূরত্বে অবস্থানসহ জনসমাগম না করা ও প্রাথমিক লক্ষণগুলো তুলে ধরা।
পরবর্তীতে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে থাকলে প্রথমেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে শপিংমল, রেস্টুরেন্টসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আরও বেশি মারাত্মক রূপ ধারণ করতে থাকলে সরকারের পক্ষ থেকে দেশটির রাষ্ট্রপতি মার্সেলো ‘স্টেট অব ইমারজেন্সি’ ঘোষণা করা হয়।
তারই ধারাবাহিকতায় নির্দিষ্ট করে কিছু এলাকাকে অঞ্চলভিত্তিক লকডাউন ঘোষণা করা হয়। সংখ্যায় বেশি বসবাসকারী জনসংখ্যার শহর ও দেশটির রাজধানী লিসবন ও বন্দর নগরী পোর্তোসহ মুহূর্তেই পুরো দেশ করোনা মহামারিতে স্তম্ভিত হয়ে যায়। তখন জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা প্রণয়ন নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে পরামর্শ ও প্রস্তাবনা শুরু করেন।
দেশটিতে বর্তমানে মোট জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২ লাখ ২৮ হাজার, স্থানীয়দের পাশাপাশি বসবাস করেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা নিয়মিত অভিবাসী (দেশটিতে অভিবাসন প্রাপ্ত) ও অনিয়মিত অভিবাসী (অভিবাসন প্রত্যাশী), তাই স্থানীয় জনসংখ্যার তুলনায় দেশটিতে বসবাসরত অভিবাসীদের সংখ্যাও কম নয়।
কারণ হিসেবে জানা গেছে, অভিবাসীদের নিয়ে দেশটির সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের প্রধান দুটো হলো- সহজশর্তে অভিবাসন (রেসিডেন্স) ও নাগরিকত্ব (সিটিজেনশিপ) দেওয়া। তাই অর্থনীতিতে দুর্বল ইউরোপের দেশগুলো ছাড়াও অন্যান্য মহাদেশ যেমন- এশিয়া ও আফ্রিকার লাখ লাখ মানুষ মান উন্নত করার লক্ষ্যে পর্তুগালে জড়ো হন।
স্থানীয় ও নাগরিকত্বপ্রাপ্ত অভিবাসীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। অভিবাসীদের ক্ষেত্রে দেশটির ‘জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা সংস্থা বা SNS’ থেকে একটি জাতীয় সেবা নম্বর নিতে হয়। এছাড়া দেশটির সামাজিক নিরাপত্তা সংস্থা ‘‘Seguranca Social’’ থেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের স্বাস্থ্য কার্ড নিতে হয়।
অভিবাসীদের মধ্যে যারা নিয়মিত হয়েছেন অর্থাৎ রেসিডেন্স কার্ড পেয়েছেন একমাত্র তারাই এসএনএস নম্বর জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা নম্বরটি ও ইউরোপিয়ান স্বাস্থ্য কার্ডটি নিতে পারেন। ফলে দেশটিতে থাকা ২ লাখ ৪৭ হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী (আবেদনকারী) যারা নিয়মিত বা রেসিডেন্স কার্ডটি পাওয়ার জন্য দেশটির ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টে ‘‘SEF’’ ইতিপূর্বে আবেদন করে অ্যাকসেপ্ট ইমেইল (ফিরতি মেইল) পাওয়া কিংবা বায়োমেট্রিক তথা ফিংগারপ্রিন্ট দেওয়ার জন্য অপেক্ষমান ছিলেন।
তাই আবেদনকারী এই সংখ্যার পুরোটাই অর্থাৎ ২ লাখ ৪৭ হাজার অনিয়মিত অভিবাসী প্রত্যাশীদের স্বাস্থ্যসেবা প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে যা অভিবাসীদের জন্য রীতিমতোই একটি দুশ্চিন্তার বিষয় ছিলো।
মহামারির এ সময়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ চেয়ে পর্তুগিজ ভাষাভাষী ব্রাজিলীয়ান, আঙ্গোলীয়দের একটি বড় কমিউনিটি ফোরাম দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করেন। পরবর্তীতে অন্যান্য প্রায় সব দেশের অভিবাসী প্রত্যাশীরা এই যোক্তিক আন্দোলনে একাত্মতা পোষণ করে দাবি আদায়ে কাজ করে যান।
ফলে পর্তুগিজ সরকারের চোখ পড়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের এই যোক্তিক আন্দোলনের ওপর। এই সাময়িক সমস্যা সমাধানের জন্য অভিবাসীদের আশাবাদী করে গড়ে তোলেন সরকারের কর্তাব্যক্তিরা।
এই আন্দোলনের ২ সপ্তাহের মধ্যেই পর্তুগিজ সরকার ঘোষণা দেন, ২ লাখ ৪৭ হাজার অভিবাসীপ্রত্যাশীদের (আবেদনকারীকে) দেশটির ইমিগ্রেশন বা ‘‘SEF’’ থেকে সার্টিফিকেটপূর্বক অস্থায়ী নিয়মিত ঘোষণা করেন। ফলশ্রুতিতে আবেদনকারীরা ইমিগ্রেশন পোর্টালে প্রবেশ করে তাদের ‘‘SEF Certificate’’ ডাউনলোড করে পরবর্তীতে ‘‘SNS’’ বা জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা সংস্থায় তাদের স্বাস্থ্যসেবা নম্বরটি পাওয়ার জন্য এলাকাভিত্তিক ইমেইলে আবেদন করা শুরু করেন।
যার মধ্যে উল্লিখিত কাগজপত্র ছিলো- ‘SEF Certificate, NIF, NISS, Junta, Passport information Page, Mobile Number’’। আবেদন করার পরের সপ্তাহ থেকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা থেকে আবেদনকারীকে ‘‘SNS Number’’ দেওয়া হয়। সেই নম্বরটি ব্যবহার করে পরবর্তীতে মহামারি কোভিড১৯ চলাকালীন অনিয়মিত অভিবাসীরা বিনামূল্যে কোভিড ১৯ শনাক্তকরণ পরীক্ষা সাধারণ চিকিৎসা পরামর্শ কিংবা অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা বা চিকিৎসা নেন।
এছাড়াও সামাজিক নিরাপত্তা সংস্থা বা ‘‘Seguranca Social’’ অফিসে শুধুমাত্র মাসিক বেতনের ট্যাক্স পরিশোধ করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের স্বাস্থ্য কার্ডের জন্য আবেদনের সুযোগ করে দেন। বৈশ্বিক এই মহামারিতে পর্তুগালে অভিবাসন প্রত্যাশী (অনিয়মিত) ২ লাখ ৪৭ হাজার অভিবাসীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে পর্তুগিজ সরকার ভূয়সী প্রশংসার এক অন্যন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
সংলাপ-২০/০৩/০০৫ /আ/আ