রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১

অপরাধ সংঘটিত হলে অপরাধী পার পায় না

প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২১ | ৪:০৫ অপরাহ্ণ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২১ | ৪:০৫ অপরাহ্ণ
অপরাধ সংঘটিত হলে অপরাধী পার পায় না

দুবাইতে অপরাধ করে বাঁচা যায় না। তাই পারতপক্ষে কেউ অপরাধ করে না। তারপরও এখানে খুবই নগণ্য কিছু ক্রাইম যে হয় না তাও নয়। যার চুরির অভ্যাস সে স্বর্গে গেলেও চুরি করবে। শৈশবে দেখেছি, এলাকায় সিঁদেল চোরকে গাছের গুঁড়ির সাথে পিঠমোড়া করে বেঁধে পেটাতে। লউক্কে চোরা, শুক্কুইজ্জে চোরা, জান্নো চোরা এই নামগুলো তখন প্রতিদিন সকালে উঠে শুনতাম। আজকে এই বাড়ি চুরি হল তো কালকে বাড়িতে চুরি হয়। ঘুরে-ফিরে প্রতিদিন এই তিনজনের নামই আসত। চোরের মার কাকে বলে সেই শৈশবে দেখেছি। আমার মনটা নরম। আমি চোরের কান্না সইতে পারতাম না। তাই চোরের মার শেষ অবধি দেখতে পেতাম না।

এখন সিঁদেল চোরের উৎপাত কমে গেছে। অভাব বিদায় নিয়েছে সেই কোন কালে। ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বাঙালিদের চির পরিচিত মঙ্গা এলাকায়ও এখন আর মঙ্গা নেই। অভাবকে জয় করেছে বাঙালি। শিক্ষার হার আশাতীত বৃদ্ধি পেয়েছে। সিঁদেল চোরেরাও এখন ঘর-বাড়ির চুরি বাদ দিয়ে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, দুর্নীতি ও ঘুষ ইত্যাদিতে মশগুল। যাদের শরীরের শোণিত ধারায় সিঁদেল চোরের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে তারাই উপরোক্ত গর্হিত কর্মে লিপ্ত। কারণ বিজ্ঞানেই প্রমানিত এই জেনেটিক ব্যপারটা। চোরের ছেলেই চুরি করবে, ডাকাতের ছেলে ডাকাতি। তবে ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। যেমন- আঞ্চলিক একটা প্রবাদ আছে, ‘আলেমের ঘরত জালেম অয়, জালেমের ঘরত আলেম অয়’।

কালে কালে সবকিছুই তো পরিবর্তন হয়েছে। আগে ব্রাহ্মণ গণকেরা বগলে গাঁটুরি নিয়ে ভাগ্য গণনার জন্য পাড়ায় পাড়ায় হাঁক-ডাক করতেন। এখন তাদের সন্তানেরা শহরে নানা জায়গায় চেম্বার খুলে ধুমসে ব্যবসা করছেন। একসময় পাড়ায় পাড়ায় ধোপা এসে কাপড় নিয়ে যেত, আবার ধুয়ে বাড়ি বাড়ি দিয়ে যেত। আর এখন তাদের উত্তরসূরিরা অটোমেটিক ড্রাই ক্লিনিং / লন্ড্রি খুলে ব্যবসায়ে আধুনিকতা এনেছেন। আগে নাপিতেরা মহল্লায় মহল্লায় একটা ছোট্ট বাক্স নিয়ে ঘুরতেন চুল-দাঁড়ি ছাটার জন্য। এখন নাপিতের বংশধরেরা আধুনিক ডেকোরেশনের সেলুন দিয়ে রমরমা ব্যবসায় করছেন। আরও অনেক কিছুতে পরিবর্তন এসেছে। সুতরাং সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায় চোরদের উত্তরাধিকারীরাও চুরির ধরনে আধুনিকতার প্রলেপ দিয়েছে। আগে চুরিতে লজ্জা ছিল, লাঞ্চিত হতে হত। এখন চুরিতে লজ্জা নেই। বরং নানা বাহানায় চুরি করতে বিদেশ ভ্রমণও করে থাকেন দেশের বিখ্যাত চোরেরা।

বলছিলাম যারা অভ্যাসের দাস হয়ে গেছেন তারা তো মঙ্গল গ্রহে গেলেও বদলাবে না। ছোটখাটো বাদ দিয়ে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা বলার চেষ্টা করব। ১৯৯২ সালের জানুয়ারির প্রথম দিকে দুবাই আল কারামার একটি আবাসিক ভবনে ভারতীয় পরিবারের পাঁচজন খুন হয়। যারা দুবাইতে ঐ সময় ছিলেন তাদের এই চাঞ্চল্যকর ঘটনা মনে থাকার কথা। ঐ সময় ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘চিত্রবাংলা’ (১১ বর্ষ, ২৪-৩০ জানুয়ারি ১৯৯২ইং) তে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হিসেবে দুবাই থেকে আমার প্রেরিত সচিত্র প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছিল। দুবাইতে বসবাসরত একটি ভারতীয় গুজরাটি পরিবারের পাঁচ সদস্য তাদেরই দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত গৃহভৃত্যের হাতে নির্মমভাবে খুন হয়। মিঃ রমেশ সাগর বার বছর ধরে বাস করছিলেন দুবাই শহরে। সেখানকার দেশি-বিদেশী ব্যাংকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করতেন। চার বছর ধরে দুবাই ন্যাশনাল ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। তার স্ত্রী মিসেস রাজুরি দুবাইস্থ ইন্ডিয়ান স্কুলে শিক্ষয়িত্রীর পদে চাকরি করতেন। মিঃ সাগর ও মিসেস রাজুরির দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে তাদের জ্যোতি (১৩) ও জয়েস (১১) নামের কন্যা ও পুত্র সন্তান ছিল। দুবাইতে এই সুখী পরিবারের সাথে রমেশ সাগরের বৃদ্ধা মাতা মোলিবাইও ছিলেন।

জানা গেছে, সাগরদের আদি নিবাস ছিল পাকিস্তানের সিন্ধু এলাকায়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তারা ভারতের বোম্বে নগরীতে স্থায়ী হয়। খুন হওয়ার বার বছর আগে তারা দুবাইতে এসেছিলেন। দুবাইতে সাগরের আপন তিন বোন ছাড়াও বেশ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন ছিল। ১৯৯২ সালেল ৪ জানুয়ারি বিকেল বেলা। দুবাই নগরীর মানুষগুলো যার যার কাজ সেরে আবাসস্থলে ফিরছে। কেউবা সপরিবারে ঘুরতে বেরিয়েছে। প্রবাসের দিনগুলোকে সবসময় আনন্দমুখর রাখার জন্য সবাই চেষ্টা করে থাকে। দুবাইয়ের কারামা নামক ভারতীয় অধ্যুষিত এলাকাটা সেদিন কেন জানি শান্ত আর গম্ভীর ছিল। এই কারামা এলাকার অভিজাত এক ফ্লাটে থাকতেন রমেশ সাগরের পরিবার। ঘটনার দিন ঘাতক রাজিবাই প্রথমে রমেশ সাগরকে তার বেডরুমে গিয়ে নির্মমভাবে খুন করে। রমেশের স্ত্রী ছিলেন কিচেনে। চিৎকার শুনে তিনি বেডরুমে আসেন। ঘাতক দরজার আড়ালে অবস্থান নেয় এবং কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই মিসেস রাজুরিকে হত্যা করে। এরপরের ঘটনা আরও নির্মম। সাগরের সন্তানরা ঘুমন্ত ছিল। তারা এসবের কিছুই টের পায়নি। কিন্তু সাগরের বৃদ্ধা মাতা বউমা’র চিৎকার শুনে ছুটে আসেন। নিয়তির নির্মম পরিহাস, ঘাতক তাকেও হত্যা করল। মহাবিক্রমে ঘাতক এবার প্রবেশ করে জ্যোতি ও জয়েসের রুমে। তাদের ইহলীলাও সাঙ্গ করে দেয় মূহুর্তের মধ্যে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের ইতিহাসে এরকম হৃদয় বিদারক ঘটনা ও দুর্ধর্ষ অপরাধ আর ঘটেনি। দুবাইয়ের পুলিশ খুবই দক্ষ হলেও সেদিন চতুর ঘাতক হত্যার পরপরই ভারতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। এতেই অনেকের ধারনা হত্যাকাণ্ডটা ছিল সুপরিকল্পিত। কথিত হত্যাকারী রাজিবাই এর বাড়ি ভারতের গুজরাটের ভালসাদ জেলায়। দীর্ঘ বার বছর ধরে রমেশ সাগরের পরিবারের সাথে ছিল সে। ঐ পরিবারের খুবই বিশ্বস্ত ছিল বলে ঘরের আলমারির চাবি পর্যন্ত তার কাছেই থাকত। রমেশের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের ভাষ্যমতে রাজিবাই ছিল নিরীহ প্রকৃতির এবং একই সঙ্গে কঠোর পরিশ্রমী।

কেন এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটল, দুবাই পুলিশ প্রাণপণ চেষ্টা করেও সেই রহস্যের জাল ছিন্ন করতে পারেনি। তাই অনেকে শংকা প্রকাশ করেছিলেন যে, আসল খুনী রাজিবাই নয়। হতে পারে, রাজিবাইকে এই হত্যাকাণ্ডে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসল হত্যাকারীরা সরে পড়েছে। কারণ ঘাতকের অতীত কার্যকলাপ সম্পূর্ণ নিরীহ গো-বেচারা ধরনের। তাছাড়া ঘাতক ৪ জানুয়ারি বিকেলে পাঁচজনকে খুন করে পরদিন ৫ জানুয়ারি ভোররাতে আমিরাত এয়ারলাইন্সে করে ভারত পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। সংগত কারনে প্রশ্ন উঠতেই পারে, এত দ্রুত পালিয়ে যেতে ঘাতক রাজিবাইকে অদৃশ্য থেকে সহায়তা করেছে কে বা কারা ? সবচেয়ে ভাবনার বিষয় হল, রমেশের পরিবারের পাঁচজনকে খুন করা ছাড়া আর কিছুই করেনি সে। এমনকি ড্রয়ারে রক্ষিত মূল্যবান অলংকার এবং নগদ টাকাতেও হাত দেয়নি সে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসতে পারে, ঘাতক মুম্বাই যাওয়ার বিমানের টিকিটের পয়সা পেল কোথায় ? এত দ্রুত টিকিটই বা ব্যবস্থা করে দিল কে ?এতগুলো প্রশ্নের উত্তরকে একপাশে ঠেলে রেখে অবশেষে ধরা পড়ল ঘাতক রাজিবাই।

ভারতে পালিয়ে গিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারেনি ঘাতক রাজিবাই। দুবাই পুলিশ হত্যাকারী সম্পর্কে বিস্তারিত ইন্টারপোলে জানিয়ে দিলে, ইন্টারপোল ভারতীয় পুলিশকে ঘটনা অবহিত করে। ভারতীয় পুলিশ ৮ জানুয়ারি (১৯৯২) রাজিবাই এর গ্রামের বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। ঐ সময় এই ঘটনা সমগ্র গালফে চাঞ্চল্যকর সংবাদ হিসেবে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। লোকের মুখে মুখে এরকম একটি ঘটনা। মানুষ বিস্মিত। দুবাইয়ের মত একটি জায়গায় এরকম ঘটনায় কেউ কেউ নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিতও ছিলেন বটে। কিন্তু সেই থেকে আজ পর্যন্ত এরকম কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়নি এটাই সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা।

  • সাংবাদিক ও কলাম লেখক
সম্পর্কিত পোস্ট